আড্ডা–পরিকল্পনা: শিশির দত্ত
(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব )
সম্প্রতি কথাসুন্দর–এর ৫ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ড.কুন্তল বড়ুয়ার আমন্ত্রণে ভারতের প্রখ্যাত নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা অশোক মুখোপাধ্যায় চট্টগ্রাম এসেছিলেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৩। প্রযোজনা ও অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি নাটকের বঙ্গায়নে তাঁর বিরল কৃতিত্ব রয়েছে। বিটা পরিদর্শনে এলে খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সময়ে কিছু তরুণ অভিনেতার সাথে তিনি সংলাপে মিলিত হন। এই সংলাপটি শুরু করেন বিটার নির্বাহী পরিচালক শিশির দত্ত। প্রথমে তিনি উপমহাদেশের স্তানিস্লাভস্কির অভিনয়রীতির একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেন তাঁকে। সেই প্রসঙ্গে আলোচনার অবতারণায় অশোক মুখোপাধ্যায় বলেন, এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বলা খুবই দুরূহ। শুধু স্তানিস্লাভস্কির অভিনয়রীতি নিয়ে কমপক্ষে সাত দিনের একটি কর্মশালা করলেও সবকিছু বলে শেষ করা যাবে না। তবে তরুণ অভিনেতাদের বিশেষভাবে স্তানিস্লাভস্কিকে জানা খুবই প্রাসঙ্গিক। তা না হলে অভিনয়টা ঠিক হয়ে ওঠে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার পরিস্থিতি তৈরি করা যায় না। যেখানে অভিনেতারাই অনেক বেশী নিজেকে গড়ে তুলতে পারে না। এই আলপচারিতা পর্বে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করেন সুচরিত টিংকু, বাপ্পা চৌধুরী, কঙ্কন দাশ, জান্নাতুন নাঈম মুক্তা ও সানজিদা আমিন।
কঙ্কন দাশ: সিনেমাতে ভালো অভিনয়ের জন্য পুরস্কার দেয়। আমরা যারা মঞ্চে কাজ করি তাদের জন্য সেইরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। তাহলে আমি কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবো?
অশোক মুখোপাধ্যায় : তোমাদের এখানে থিয়েটারের লোকেরা শুধু রাষ্ট্রীয় সম্মান পান। একুশে পদক আর স্বাধীনতা পদক। বছরের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা বা শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এইরকম কোনো পুরস্কার নেই। এমন পরিস্থিতিতে এটা ভীষণ কষ্টকর। এটা থাকাটা দরকার।
জান্নাতুন নাঈম মুক্তা: আমরা অনেক সময় দেখি মঞ্চে আমাদের সহঅভিনেতা অনেক সময় নিজে থেকে ইম্প্রোভাইজ করেন। যেটা হয়তো মহড়াতে উনি করেননি। হঠাৎ করে মঞ্চে করে বসলেন। সেক্ষেত্রে একজন অভিনেতা হিসেবে আমি কি করতে পারি?
অশোক মুখোপাধ্যায় : সেটা সহঅভিনেতাকে বোঝাতে হবে। তুমি নির্দেশককে সেটা জানাবে। অথবা নির্দেশক বুদ্ধিমান হলে তিনি অবশ্যই সেটা খেয়াল করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। মহড়াতে তিনি যা করতে চান তা যোগ করতে পারেন। একটা সংলাপের এইটুকু বলে আমি একটু পস্ নেব বা একটু হাসবো। তারপর পরের সংলাপ বলবো। নির্দেশক সেটাকে অনুমোদন করলে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ইচ্ছে হলো মঞ্চে কিছু একটা করে বসলাম এটা তো পুরো নাটককেই বিপদে ফেলে দেবে। এটা করা ঠিক নয়, অন্যায়।
বাপ্পা চৌধুরীর: বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকগুলো নাটকের ইনস্টিটিউশন গড়ে উঠেছে। অনেক ছেলেমেয়ে নাটকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করছে। কিন্তু সেইভাবে নাটকের ক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি। ফলে ছাত্রদের মাঝে এক ধরনের হতাশা দেখতে পাই। পাশ করে বের হয়ে কি করবে? আবার এটাও সত্যি কেউ এই ক্ষেত্রটা তৈরি করে দেবে না। আপনিতো দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। এই ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কি হতে পারে?
অশোক মুখোপাধ্যায় : এটা কারো একার সমস্যা না। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। থিয়েটারের লোকেরা থিয়েটারটা করতে পারবে। কিন্তু থিযেটার করার পরিকাঠামো যদি আমাকেই করতে বলা হয়, আমি কি করে করবো? তবে শুধু হলে বসে থিয়েটার করার কথা ভাবলে তো হবে না। হলের বাইরেও থিয়েটার করার কথা ভাবতে হবে। মুক্ত–নাটক আছে। পথ–নাটক আছে। নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। স্কুল কলেজে টিআইই বা থিয়েটার ইন এডুকেশন হতে পারে। থিয়েটার একার লড়াই না। এটা আগে দেশের লোককে বুঝাতে হবে।
সানজিদা আমিন : নাট্যকলা একটা ডিসিপ্লিন। আমরা সবাই সেই ডিসিপ্লিন এর মাধ্যমে পড়ালেখা শেষ করছি। কিন্তু আমাদের পরিবার এখনো নাটককে সেভাবে গ্রহণ করে না। তাদের প্রশ্ন নাট্যকলাতে পড়ে আমি কি করবো।
সুচরিত টিংকু: নাট্যকলাতে পড়লেই যে নাটক করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। বাংলায় পড়েও অনেকে ব্যাংকে কাজ করছে।
কঙ্কন দাশ : আমি যখন নাটকে এসেছি তখনের বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাটকে নাচ, গান সবকিছুই সংকুচিত হয়ে আসছে। আমরা একটা গন্ডির বাইরে কিছুই করতে পারছি না। পেশা হিসেবে নাটককে গ্রহণ করা সেটা তো অনেক কঠিন কাজ। চট্টগ্রামের এক সময়ের অনেক নামকরা পারর্ফমার এখন নাটকই করেন না। এই জায়গাটা আমাদের ভাবতে হবে, অনেক সুযোগও রয়েছে। আমি বলবো সেই ক্ষেত্রে নতুনদের একটা বড় দায়বদ্ধতা রয়েছে।
অশোক মুখোপাধ্যায়: আমরাও অনেক সমস্যার মধ্য থেকে শুরু করেছিলাম। আমিও সারাদিন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি। তারপর বাড়ি গিয়ে স্ত্রী–র হাতে টাকা দিয়ে বলেছি সংসার চালাও, আর আমি বিকেলে গিয়ে থিয়েটার করেছি। এখন যে সিরিয়াল করে কোলকাতায় সে–যে সুখে আছে তা না। তার সমস্যা আরও জটিল। তাকে পাঁচটা ঘর সামলাতে হয়। আজকে এই ফ্লোরে কাল অন্য ফ্লোরে সব আলাদা আলাদা কাজ। তিন জায়গাতে তিনজন ডিরেক্টর সামলাতে হচ্ছে। তবে যে আলোচনাটা চলছিল স্থান সংকুচিত হচ্ছে এটা আমাদের ওখানেও হচ্ছে। নাসিরউদ্দিন শাহ কিংবা শাহরুখ এর মতো ভালো অভিনেতাদের যথেষ্ট ভয় পেতে হচ্ছে এই জমানাকে। এত বাজে একটা সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে এই লড়াই শুধু আমাদের লড়াই না। সমাজের সব মানুষের লড়াই। এই বাঁচার লড়াইয়ে যদি আমরা হেরে যাই তাহলে শুধু থিয়েটার কেন; সিনেমা, গান, নাচ সংকীর্তন সবই হারিয়ে যাবে।