কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কুলি ও মজুর’ কবিতায় বিশ শতকের পরাধীন ভারতে শ্রমজীবী মানুষদের শ্রম, ঘাম, রক্ত, হাঁড়–মাংস, প্রাণ আর সম্মানের বিনিময়ে বদলে যাওয়া ভারতবর্ষের উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন এইভাবে–
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে
রেলপথে চলে বাষ্পশকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে
বল তো, এসব কাহাদের দান ?
তোমার অট্টালিকা, কার খুনে রাঙা ?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লেখা …
শতবছর পর দু’হাজার তেইশ সালে রমজানের এক তপ্ত দুপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের বন্দর শহর চট্টগ্রামে উড়াল সড়কের ওপর দিয়ে ছুটে চলা মালবোঝাই ট্রাক থেকে খড়কুটোর মতো করে গড়িয়ে পড়ে এক হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার দিনমজুর। না, তাকে রোজায় ধরেনি। রোজা রাখার সাধ্য–ইচ্ছে কোনটাই তার নেই। ক্ষুধার জ্বালা ভুলে থাকতে সুল্ভ মূল্যের বিড়িই তার সহায়। শ্রান্ত ঘর্মাক্ত শরীর তা মানবে কেন? ট্রাকের খোলা ছাদে চোখ লেগে আসে ক্লান্তিতে। ঝকঝকে উড়াল সড়কে গতির কাঁটা সীমা ছাড়িয়ে যেতেই পলকা শরীরটা চোখের পলকে ধসে পড়ে দোতলা রাজপথে। থেতলে যায় শরীরের একপাশ। নিস্তব্ধ শরীরের পাশে খান খান হয়ে পড়ে থাকে প্রাচীন মুঠোফোন। বাহ! হতদরিদ্র শ্রমিকেরও নিত্যসঙ্গী এখন মুঠোফোন। নিঃসন্দেহে তা উন্নয়নের স্মারক। পেটে ভাত জোটেনা, পরনের কাপড় তেল চিটচিটে, শতছিন্ন। কিন্তু একটি মুঠোফোনের গর্বিত মালিক সে! আমরা যে অনেক এগিয়ে গিয়েছি, প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয়, তার সাক্ষ্য দিয়ে যায় হাড় হাভাতে মজুরের হাতে ধরা কথা বলার যন্ত্রটি। তরুণ এক গাড়িচালক ব্যস্ত সড়কের বাঁ দিকে গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে রাখা পানি নিয়ে ছুটে যায় মুমূর্ষের কাছে। সেপথ দিয়েই যাচ্ছিল আইনের পোশাক পরিহিত এক তরুণ কর্মী। দুই তরুণ প্রাণ দিয়ে সেবা করে এবং একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা থামিয়ে আহতকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। উড়াল সড়কে থেতলে যাওয়া শ্রমিকটি বেঁচে আছে কি না জানা যায়নি, জানার সুযোগও হয়নি। জানার প্রয়োজনইবা কি? সেই হতভাগা শ্রমিকতো আমাদের আপনজন নয়।
তপ্ত দুপুরে দুঃস্বপ্নের মতো দেখা সেই স্মৃতি ভুলে যেতে খুব বেশী সময় লাগেনি। কারণ দিনকয় পরেই এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে সংবাদ আসে খবরের কাগজে– নগরীর ব্যস্ততম এলাকা অক্সিজেন মোড়ে (যেখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক এবং খুব সম্ভবত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক ব্যয়বহুল গোলচত্বর) মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক তরুণ রিকশা চালক। এই তরুণটি হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় মাথা ঘুরে পড়ে যায়নি। আমাদের উন্নয়নের স্মারক বৈদ্যুতিক তার বলা নেই কওয়া নেই ছিঁড়ে এসে পড়ে জাহেদ নামের সেই যুবকের রিকশার ওপর। ভেজা রিকশা মুহূর্তেই তড়িতাহত হয়, আতশবাজির মতো ছুটতে থাকে আলোর ফোয়ারা। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিকশা ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাংলা মায়ের আরেক হতভাগ্য সন্তান। ভাগ্যবান সন্তানেরা অবশ্য সেই অভূতপূর্ব আতশবাজির স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র মুঠোফোনে ধারণ করতে ভুল করেননি। জাহেদের ভেজা সড়কে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ হারানোর চলমান ছায়াছবি সংবাদকর্মীদের তাৎক্ষণিক রশদ যুগিয়ে গিয়েছে, একথা মানতেই হয়। সপ্তাহ জুড়ে খবরের কাগজতো বটেই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে গিয়েছিল জাহেদের ভেজা গামছায় ঢাকা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছবিটি। জাহেদের তরুণী স্ত্রী, আর শিশু কন্যাকে নিয়ে বড়ই চিন্তিত হয়ে পড়ি আমরা, নাগরিক সমাজ। পরের সপ্তাহে আমাদের ভাবনা থেকে হারিয়ে যায় মৃত জাহেদ, তার স্ত্রী–কন্যা। আমাদের সভ্যতা, উন্নয়ন, সাফল্যের চালচিত্র এমনই। কোনো কিছুই আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করেনা।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছায়াছবিগুলোর অন্যতম টাইটানিকের নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়। বিশাল বরফখণ্ডের সঙ্গে সবে ধাক্কা খেয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জাহাজখানা। জাহাজের নাবিক, সারেঙ সবাই বুঝতে পারে মৃত্যু আসন্ন, বাঁচার পথ নেই। প্রকৌশলী অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে জানিয়ে দেন বড়জোর দু’ঘণ্টা ভেসে থাকবে জাহাজ। তারপর তলিয়ে যাবে হিমশীতল অথৈ মহাসাগরে। ভেসে থাকার সময়টাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য জাহাজের ওজন কমানো ভীষণ জরুরী। এমতাবস্থায় প্রথমেই নির্দেশ আসে নীচতলাকে হিসেবের খাতা থেকে মুছে ফেলতে। বলা বাহুল্য, নীচ তলায় গনগনে আগুন আর কয়লা ভরা চুল্লি ঘিরে অবস্থান করছিল ঘর্মাক্ত, হাড় জিরজিরে শ্রমিকের দল, যারা দিনরাত আগুন জ্বালিয়ে রেখে জাহাজখানাকে সচল রাখছিল। ওপরের দিকে ঐশ্বর্যের কী ছড়াছড়ি চলছিল তা ওদের জানাই হলনা। ভাঙনের মুখে নির্দেশ আসা মাত্রই ফটক নামতে শুরু করে নীচতলার । দ’ুচারজন শ্রমিক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কোনমতে ফাঁক গলে বেরিয়ে এলেও বেশীর ভাগই আটকে ছিল অগ্নিকুণ্ডলীর পাঁকে। ওদের জীবনের যবনিকাপাত কেমন করে হল, আগুনে পুড়ে অঙ্গার হল নাকি সাগরে সলিল সমাধি– ইতিহাসে সেকথা লেখা হয়নি, চলচ্চিত্রেও তা দেখানো হয়নি। আমাদেরইবা ওদের ভাগ্য নিয়ে ভাবার কি প্রয়োজন ? ওরাতো বরাবর ইতিহাসের পার্শ্বচরিত্র।
টাইটানিক ছায়াছবির সেই অনুল্লেখযোগ্য দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের সমাজে আজকের ঘটনাপ্রবাহের অনেক মিলই খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের সমাজের পার্শ্বচরিত্র শ্রমজীবী জনসাধারণকে আমরা বরাবর খরচের খাতায় রেখেই আমাদের যাবতীয় হিসেব কষি। কারণ ওদের যোগান প্রবাহ চলমান ও সীমাহীন। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে ওদের শ্রম–ঘাম রক্তের কোনো কমতি নেই। কারখানা মালিক, জনপ্রতিনিধি কিংবা সমাজের ভাগ্যবান নাগরিকদের তাই কোন ভাবনাও নেই ওদের নিয়ে। নির্মাণাধীন কোন ভবন, সড়ক, সেতু বা যে কোন স্থাপনার কাছে গিয়ে কিছু সময় অবস্থান করলেই বোঝা যায় কী ভীষণ অমানবিক আমাদের এই উন্নয়ন পরিক্রমা! একুশ শতকের স্বাধীন বাংলাদেশে আজও ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় চলছে নির্মাণযজ্ঞ। প্রতিদিনই মরছে কোন না কোন নির্মাণ শ্রমিক, কেউ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, কেউবা দেয়াল চাপা পড়ে, কেউবা ইটের আঘাতে, আবার কেউবা বহুতল ভবন থেকে পড়ে গিয়ে। আরও নানান পন্থায় ওদের প্রাণহানি ঘটে, নিদেনপক্ষে অঙ্গহানি। এসবের কোনোটাকেই নিছক দুর্ঘটনা বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলেনা। পোশাক শ্রমিক, আর পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ায় কর্মরত লক্ষ লক্ষ অদক্ষ নারীপুরুষ, যাদের হাত ধরে রাশি রাশি বিদেশী মুদ্রা আসে, বিনিময়ে জাতীয় অর্থনীতির চাকা ঘোরে, তাদের দুর্ভোগ আর অসম্মানের বয়ানতো এক কথায় শেষ হবার নয়।
উন্নয়নের সুফল উপভোগকারী আমরা সুশীল সমাজের সভ্যগণ এসব নিয়ে ভাবতে চাইনা। শহর আঁধার করে দেওয়া উড়াল সড়ক, সড়কের দুই ধারে আকাশ ঢেকে দেওয়া দালানকোঠা, নদীর দুই কূল এক করে দেওয়া অতিকায় সেতু দেখে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকি আমরা ভাগ্যবান বঙ্গ সন্তানেরা। যাদের ঘাম রক্ত প্রাণের বিনিময়ে আমাদের জীবনযাপন ও পথচলা সহজ ও মসৃণ হয়, তাদের কথা আমরা তাই অনায়াসেই ভুলে যেতে পারি। তবে নজরুলের পঙক্তি ক’টি হৃদয়হীনকেও নাড়া দিতে পারে গভীরভাবে
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধুলি
তারাই মানুষ তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে
আসে নব উত্থান।
সভ্যতা ও উন্নয়নের জিকির তুলে আত্মতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকা সমাজের অগ্রগামী গোষ্ঠীর জন্য মানবতা ও সাম্যের কবি নজরুলের অমোঘ বাণী–
আসিতেছে শুভ দিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা
শুধিতে হইবে ঋণ।