দেশের অন্যতম বৃহত্তম শুটকি পল্লী কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকসহ জেলার সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরে এখন পুরোদমে শুটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে সাগরে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাজারে নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ আসা শুরু হলে ধীরে ধীরে শুটকি মহালেও উৎপাদন শুরু হয়। চমৎকার আবহাওয়া ও সূর্যালোকের কারণে গত কয়েকদিন ধরে চলছে পুরোদমে উৎপাদন, আর বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে টাটকা শুটকি।
নাজিরারটেক শুটকি মহালে ৫ শতাধিক ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঁচা মাছ শুকিয়ে শুটকি মাছ তৈরির ব্যবসা করেন। এ শুটকি মহালে এখন দৈনিক গড়ে ৫শ মেট্রিক টন মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান নাজিরারটেক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ সওদাগর। তবে তা গত বছরের তুলনায় অর্ধেক জানিয়ে তিনি বলেন, নাজিরারটেক শুটকি মহালে গত মৌসুমে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১২শ টন পর্যন্ত মাছ শুকানো হয়। কিন্তু এবছর মাছ সরবরাহ কম থাকায় এবং মাছের দামও বেশি থাকায় শুটকি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ বছর মাছের দাম প্রায় ৩০ ভাগ বেড়েছে বলে তিনি জানান। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেকের সমুদ্র তীরবর্তী বালুচরের প্রায় ১শ একর জমিতে গড়ে ওঠেছে এ শুটকি পল্লী। সাগর থেকে ধরে আনা প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছ এই বালুচরে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুটকি। এখানে কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। যারমধ্যে অধিকাংশই নারী। সাগরের বালিয়াড়িতে বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার উপর কাঁচামাছ বিছিয়ে সূর্যের তাপে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুটকি। কাঁচা মাছ সূর্যের তাপে শুকিয়ে শুটকি হতে ৩/৪ দিন সময় লাগে। এরপর উৎপাদিত শুটকিগুলো বস্তাবন্দী করার পর ট্রাকবোঝাই করে পাঠানো হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। কিছু শুটকি বিদেশে রপ্তানিও করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে নাজিরারটেক শুটকি মহালে মাছের গুঁড়াসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন শুটকি উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। জেলার অন্যান্য এলাকাতেও নাজিরারটেকের প্রায় সমপরিমাণ শুটকি উৎপাদিত হয়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বদরুজ্জামান বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা বিশেষজাতের ছোট আকৃতির মাছগুলো দিয়ে শুটকি উৎপাদন করা হয়। এখানে উৎপাদিত শুটকি শুধু কক্সবাজারে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ সারাদেশের মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। এমনকি এখানে উৎপাদিত শুটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুটকি থেকে পূরণ হচ্ছে।
নাজিরারটেক শুটকি মহালের ব্যবসায়ী মো. নুরুদ্দিন কোম্পানি জানান, এখানে রূপচাদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্যা, পোপা, টেকচাঁদা, হাঙর, ফাইস্যা ও নাইল্যামাছসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের শুটকি তৈরি করা হয়। বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির সময় ছাড়া বছরের ৬/৮ মাস এখানে শুটকি উৎপাদন চলে। আর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত ভরমৌসুমে এখানে প্রতিদিন গড়ে দুইশত থেকে আড়াইশ মেট্রিক টন করে শুটকি উৎপাদিত হয়।
নাজিরারটেক শুটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিকউল্লাহ কোম্পানি জানান, দেশের অন্যতম বৃহত্তম এ শুটকি মহালে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ত রয়েছে। বিশ হাজার শ্রমিক ছাড়াও এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন প্রায় হাজার খানেক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এ শুটকি মহাল থেকে সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেলেও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া গুণতে হয় অতিরিক্ত। আবার মাছের দামও এবছর বেশ বেড়েছে। ফলে একদিকে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে শুটকি উৎপাদনেও ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
নাজিরারটেকসহ জেলার সমুদ্র উপকূলীয় উন্মুক্ত বালুচরে সনাতনী পদ্ধতিতে শুটকি উৎপাদন হলেও সাম্প্রতিককালে শহরে গড়ে ওঠেছে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অর্গানিক শুটকি তৈরির কারখানাও। একসময় কেবল সাগরে মাছধরা নৌকাতে শুকানো হত এই ধরনের শুটকি, যেখানে বাড়তি কিছুই ব্যবহার করা হত না। সাগরের মতোই একই কায়দায় এখন অর্গানিক শুটকি তৈরি করা হচ্ছে শহরে।