শুঁটকি : অল্পস্বল্প

বিপুল বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

আমাদের তথা চট্টগ্রামবাসী ভোজন রসিকদের খুবই পছন্দের একটি খাবার শুঁটকি। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এ আপ্তবাক্যের মাঝেই মাছ আমাদের অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য হিসেবে আমাদের যাপিত জীবনে খাওয়াদাওয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে জড়িয়ে আছে।

সামুদ্রিকনদীহাওর বাওরের মাছ আমাদের মাছের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব উৎস হতে প্রাপ্ত কাঁচা মাছ এক সময় শুঁটকি হিসেবে অবলীলায় উঠে এসেছে আমাদের প্রায় সবার খাদ্য তালিকায়।

শুঁটকিসেই মনমাতানো স্বাদছড়ানো শুঁটকি আজ আমাদের ঘরোয়া পরিমণ্ডলেবাড়ির নারী মহলেঅন্তঃপুরে খাদ্য তালিকায় একটি বিশেষ স্থান দিব্যি দখল আছে।

শুঁটকি সে কতো ধরনের শুঁটকি। আমাদের সমৃদ্ধ মৎস্যভাণ্ডারের সে অনেক অনেক মাছ শুঁটকি হয়ে আমাদের খাওয়ার পাতে এসে পৌঁছেছে তা বলাইবাহুল্য।

কিছু শুঁটকি : এসবের মধ্য হতে আমাদের রমণীকুলের হেঁশেলের ভারি পছন্দের তালিকায় দেখিফাইস্যা, ছুরি, লইট্যা, গুরা, পুঁটি, পোপা, হিচডি, নাইল্যা, ফাত্রা, মাইট্যা, চিংড়ি প্রভৃতি শুঁটকি। এর পরও আরো করা যায় চাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, ইলিশ শুঁটকির নাম। এগুলো আহরণ করা হয় প্রধানত নদীসমুদ্র হতে। নদীসমুদ্র হতে বিশেষত শীত মৌসুমে মৎস্যজীবীরা এসব মাছ শিকার করে কেউ কেউ হাটেবাজারে কাঁচা মাছ হিসেবে বিক্রি করে, আবার অধিকসংখ্যক মৎস্য প্রাপ্তির সুবাদে কেউ কেউ বাণিজ্যিকভাবে এসব মাছকে বিশেষত চরাঞ্চলে মৎস্য চাতালমহালগুলোতে মাচা বেঁধে সূর্যের তাপে শুকিয়ে নানাভাবে প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকি বানিয়ে মাছের আড়তে বিক্রির ব্যবস্থা করে।

আবার বৃহত্তম সিলেট : সুনামগঞ্জকিশোরগঞ্জ হাওরবাওড়ের মিঠা পানির বেশ কিছু সংখ্যক মাছ আমাদের মৎস্যপ্রেমীদের কাছে যথেষ্ট আদৃত হয়ে আছে, এগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা যায়পাবদা, বাচা, করাবাচা, ফলি, আনলি, বজরি, টুমা, ঘইন্যা, কালাবাউস, রিটা মাছের শুঁটকির কথা বিশেষভাবে বলা যায়, এখানে উল্লেখ্য এসব মিঠা পানির মাছের শুঁটকি এখন আর করা হয় না বলা চলে। এসব মাছ আহরণের অঞ্চল বিশেষে কাঁচা মাছ হিসেবে যথেষ্ট দরদামে বিক্রিত হচ্ছেএমনি অন্যত্র আসছে কাঁচা মাছ হিসেবে।

শুঁটকির পদবাচ্য কথা : রান্নাঘরহেশেলের শুঁটকি বা শুঁটকির তরকারি চুলোয় তুললে আশপাশের দু’দশ বাড়িবাসা শুঁটকির তেলে চড়ানো ঘ্রাণে মৌ মৌ করে আশপাশ মাতিয়ে তোলে, চারদিক আমোদিত করে।

রসনাবিলাস শুঁটকি : কিছু কিছু আটপৌরে পদরান্নার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতেই হয়শুঁটকি ভর্তা বা চান্নির কথা। এখানে বিশেষত লটিয়াফাইস্যাচিংড়ি (ইচা) শুঁটকি পুড়িয়েচুলায় পাত্রে ভেজে পিয়াঁজতেল সহযোগে যে ভর্তাবাজি প্রস্তুত করা হয় তা খাওয়ার টেবিলে বেশ সমাদৃত হয় ভোজনরসিকদের কাছে। শুধু কি ভর্তাবাজি করা গুরামিশেল শুঁটকি, ফাইস্যা, ফাত্রা দিয়ে শুঁটকির মরচে ঝোলগরম গরম ভাত খাওয়ার মজাটাই আলাদা বিশেষত শীতকালে। গাঁওগেরামে এ ধরনের শুঁটকি পদের ঝোল খুব আহ্লাদের সাথে খেয়ে ঢেকুর তোলা যায় আয়েশে।

শুঁটকির দোমাছা : শুঁটকি ও ছোট কাঁচা চিংড়িবেলে মাছমলা মাছ দিয়ে করা একটি ভারি সুস্বাদু পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের খাওয়ার টেবিলে। এই দু’মাছের (শুঁটকি ও কাঁচা ছোট মাছের) মিশেল মাছ ঝাল করে খানিকটারান্না বেশ মজাচ্ছে খেয়ে রসনাপূর্তি করতে অনেক অপেক্ষা করেন, ছোটখাটো ঘরোয়া আচারঅনুষ্ঠানেবৈঠকী খাওয়ার আয়োজনে।

ঘইন্যা (হুনি) শুঁটকি : কাঁঠাল বিচির তরকারি শুঁটকিপ্রিয় মোহিতজনদের খুব পছন্দের। এখানে কাঁঠাল বিচিকে বেশ করে ভিজিয়ে রেখে ঘইন্যা শুঁটকি দিয়ে ভালো মসলাপাতি সহযোগে যে রান্না করা হয় তা পাতে নিতে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় হামেশা, ঘইন্যা হুনিকাট্টল (কাঁঠাল) বিচি আমাদের চট্টগ্রামের গ্রামশহর এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুবই পছন্দের একটি শুঁটকির পদ। ছুরি শুঁটকির বেশ কয়েকটি আকার প্রকারভেদশুঁটকির রাজত্বে খুব চোখে পড়ে। ছোট ছুরিবড় ছুরিছুরির জরা এভাবে ছুরি শুঁটকিকে বিভাজনে ফেলা যায়, শুঁটকিপ্রেমিদের কাছে এত সবের মাঝে ভারি পছন্দের বড় ছুরি বা বদরের ছুরি, সোনাদিয়ার ছুরির খুব নামডাক। এই বদরের ছুরির সাথেও চমৎকার কিছু কিছু গল্পউপকথা প্রচলিত রয়েছে আমাদের চলতি বৈঠকআড্ডাবয়ানে। বেশ চ্যাপ্টামতো দু’তিন টুকরো বদরের ছুরি দিয়ে মাঝারি এক হান্ডি (কড়াই) বেগুনআলু রান্না করলে খেতে বসলে মাছমাংসের ধারে কাছে কেউ যেতে চাইবে নাএকথা হলফ করে বলা যায়।

ইলিশ শুঁটকি (নুনিয়া ইলিশ) : কাঁচা ইলিশ স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে মাসখানেক সারিবদ্ধভাবে রেখে দিয়ে নুনিয়া ইলিশের পর্যায়ে তৈরি করা হয়। এই নুনিয়া ইলিশ লাউ পাতা দিয়ে মুড়িয়ে চুলোয় ভেজে নিলে এক মহা উপাদেয় খাদ্যবস্তুতে রূপ নেয়। নুনিয়া ইলিশ তেলে দিলে তার সুগন্ধে চারদিকে কি মৌতাত ছড়িয়ে দেয় তা আর বলার রাখে না। চাঁদপুর, কক্সবাজার, মহেশখালী, খুরুসকুল সামুদ্রিক উপকূলীয় এলাকাগুলো হতে মৎস্যজীবীরা ইলিশ শিকার করে তা পরবর্তীতে প্রক্রিয়াজাত করে নুনিয়া ইলিশ হিসেবে বাজারজাত করেযা অনেকাংশে শুঁটকি হিসেবে সবখানে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘ সময়কাল ধরে। তেল চপচপে নুনিয়া ইলিশের স্বাদগন্ধ সত্যিই অতুলনীয়।

বনেদি শুঁটকি : শুঁটকির বিশাল সাম্রাজ্যে বেশ কিছু বনেদী শুঁটকিরূপচাঁদা, লাক্ষ্যা, কোরাল ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এসব শুঁটকি খুবই সুস্বাদু ও রসনাবিলাসী জনমাত্ররই ভাবি পছন্দের। অন্যান্য শুঁটকির তুলনায় এ ধরনের শুঁটকির দামদস্তর ও খুব বেশি। এসব শুঁটকি ব্যক্তি বিশেষের কাছে খুব আদরণীয় বলা হয়ে থাকে।

পাতে বৈচিত্র : শুঁটকি আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় অঙ্গাঙ্গিভাবে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আমাদের ঘরকন্নার নানা তরিতরকারি সুস্বাদু করার নিমিত্তে ছোটবড় নানা পদের শুঁটকি বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমাদের রান্নাঘরে খাবারের নানা পদ তৈরিতে আমরা প্রতিনিয়ত মাছমাংসের পাশাপাশি হরেকরকমের শুঁটকিকে বেছে নিই। বিশেষত শীতকালে এই শুঁটকি মিশেল তরকারি, শুঁটকির ভাজিভর্তাচান্নি আমাদের শহুরেগ্রামীণ সমাজজীবনে খাওয়ার পাতে বহুধা বৈচিত্র্য প্রদান করে।

শুঁটকির উৎস : আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় ভোজনরসিকদের কাছে শুঁটকি একটি অত্যন্ত প্রিয় ও সুস্বাদু খাদ্যবিশেষ হিসেবে বহুলভাবে পরিচিত। আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাকক্সবাজার, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, খুরুসকুল, গোরকঘাটা, নুনিয়াছড়া, নাজিরারটেক প্রভৃতি এলাকায় প্রায় ১০ লাখ লোক মৎস্য আহরণশিকারপ্রক্রিয়াজাত কার্যকারণে নিয়োজিত রয়েছেন। তাছাড়া খুলনা অঞ্চলের রাঙাবালী ডুবলার চর প্রভৃতি এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৎস্যজীবী মাছ শিকার করে বাজারজাতকরণের কাজ দীর্ঘসময় ধরে করে চলেছেন।

শুঁটকির শহর চট্টগ্রামে : শুঁটকি সারা দেশ জুড়ে বিক্রিবাট্টা হয়ে আসছে দীর্ঘসময় ধরে। সে হিসেবে চট্টগ্রামেও শুঁটকির প্রধানতম আড়ত ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত রয়েছে আছদগঞ্জ (আসু রাস্তা)। এই আড়তে দৈনিক লাখ লাখ টাকার শুঁটকির বিকিকিনি। শুঁটকি ব্যবসাকে একটা যুগান্তকারী পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সারা দিনমান শুঁটকি কেনাবেচার, খুচরা আড়তদারি ব্যস্ততম ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে জমজমাট পরিগণিত হয়ে আসছে।

শেষ কথা : শুঁটকির শেষ কথা অবশ্যই শেষ কথা নয়। শুঁটকি নিয়ে আরো অনেক অনেক কথা রয়েছে। রয়েছে শুঁটকির গুণবিচার নিয়েভালোমন্দ নিয়ে অনেক অনেক কথাআলোচনা উল্লেখের দাবি রাখে। শুঁটকি নিয়ে জনসম্পৃক্ততা, অর্থনৈতিক অবস্থান, রপ্তানি বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ, প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা এমনি বহুবিধ আলোচনা এখানে বিবৃত করা না গেলে বলা যায় শুঁটকি নিয়ে বিস্তর আলোচনামতামত প্রদান এই মুহূর্তে করা গেলেও একথা অবলীলায় বলা যায়শুঁটকি আমাদের হেশেল ঘরেররমণীকুলেরখাদ্যরসিকদের কাছে অত্যন্ত উপাদেয়সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে বেঁচে থাকবে আমাদের সমাজজীবনেজনজীবনে এবং অবশ্যই প্রাত্যহিক জীবনেও।

লেখক : গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুহাম্মদ মহসিনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ছোট ভাই সাবের আহমদের ইন্তেকাল
পরবর্তী নিবন্ধচাটগাঁর বেলা বিস্কুট