শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার

কুষ্টিয়ায় সেনা অভিযান ঢাকায় তাদের ২ সহযোগী গ্রেপ্তার

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ২৮ মে, ২০২৫ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার একটি বাড়ি থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি পিস্তল, চারটি ম্যাগজিন ও ১০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দারা জানান, ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদের পাশের একটি তিনতলা বাড়ি ঘিরে রাখেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর কমপক্ষে পাঁচটি গাড়ি অভিযানে অংশ নেয়। ওই বাড়ির নিচতলা ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালানো হয়। অভিযান চালানো বাড়িটি স্থানীয় মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন। বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মেস ভাড়ায় থাকেন। খবর বাংলানিউজের।

সুব্রত বাইন কে : সুব্রত বাইনকে বলা হয় ঢাকাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘গ্যাং কিলিং মাস্টার’। রাজধানী ছাপিয়ে বিভিন্ন জেলায় তার খুনের অভিযোগ আছে। তার নামে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায়ের খবর আছে অজস্র। তার অপরাধের পরিধি শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশেও একদা তৎপর ছিলেন সুব্রত বাইন।

জানা যায়, ১৯৮৭ সাল থেকে মগবাজারকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিচরণ করতে শুরু করেন সুব্রত বাইন। রফিক নামে একজনকে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনাখুনিতে জড়ান সুব্রত। এরপর একে একে ট্রিপল, ডাবল মার্ডারের অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে।

আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যে, আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুব্রত বাইনের আবির্ভাবের পর গ্যাং কিলিংয়ের ঘটনা বেড়ে যায়। মূলত সুব্রত বাইনই আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং কিলিং প্রবণতা বাড়াতে ভূমিকা রাখেন। মুরগি মিলন নামে এক সন্ত্রাসী খুন হওয়ার পর এই অভিযোগ মাথায় নিয়ে সুব্রত বাইন দেশ ছেড়ে পালান। আত্মগোপন করেন কলকাতায় আত্মগোপন। পরে সেখানেও অপরাধে জড়ালে ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।

এক পর্যায়ে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, দুবাই, নেপাল ভ্রমণ করে সেসব দেশের অপরাধীদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এমনকি আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গেও তার যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। ওই সময় ভারত সরকার তার নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করে। নেপালে আত্মগোপনে থাকাকালে ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন সুব্রত। তবে ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর তিনি দেশটির কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পালান। পরে অবশ্য আবার কলকাতায় গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তাকে দেশে ফেরাতে ভারতের সঙ্গে একাধিকবার বাংলাদেশ সরকার চিঠি চালাচালি করে। কারাগারে বা বাইরে, যেখানেই থেকেছেন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী, তার নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

সুব্রত বাইনের বাবা গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা বিপুল বায়েন এবং মা কুমুলিনি বায়েন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। পারিবারিক জীবনে তার একাধিক বিয়ের খবর পাওয়া যায়।

কিলিং মেশিন মাসুদ : ১৯৯৭ সালে রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা সংলগ্ন সড়কে মামুন নামে একজনকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন মাসুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি পরিচিত মোল্লা মাসুদ নামে। অপরাধ জগতে ‘কিলিং মেশিন’ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড।

মাসুদের বাড়ি ঝালকাঠির মহাদেবপুর। তার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। বাসা ঢাকার রমনার মিরবাগে। সুব্রত বাইনের মতো মোল্লা মাসুদের নামেও ইন্টারপোলে রেড নোটিশ রয়েছে। বহু অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মোল্লা মাসুদ ২০০৪ সালে ঢাকায় ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়ে গেলে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকেই মাসুদ বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে বিভিন্ন সময় মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে আসছিল। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে চাঁদার টাকা তার কাছে পৌঁছে দিতেন।

কলকাতায়ও অপরাধে জড়ালে মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করে সেখানকার সিআইডি। তখন দিল্লি থেকে বিষয়টি জেনে তাকে দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয় ঢাকার সরকার।

ঢাকায় দুই সহযোগী গ্রেপ্তার : বিডিনিউজ জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে ঢাকা ও কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর। গতকাল বিকালে ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য দেয় আইএসপিআর।

সংবাদ সম্মেলনে আইএসপিআর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামিউদদৌলা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের একটি ইউনিট দুজন তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের দুজন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। গ্রেপ্তার চারজন হলেন সুব্রত বাইন, আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ, শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ।

তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আজ (গতকাল) আনুমানিক ভোর ৫টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানে কুষ্টিয়া জেলা থেকে শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে।

আইএসপিআর বলছে, এই চারজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম। অভিযানে তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন জব্দ করার কথাও বলেছে আইএসপিআর।

দেড় মাস আগে বাসায় উঠেন : সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ কুষ্টিয়া শহরের যে বাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেটি স্থানীয় এক ব্যক্তি ব্যবসা ও আত্মীয়দের থাকার কথা বলে ভাড়া নেন বলে জানিয়েছেন ভবনের অন্য বাসিন্দারা।

কুষ্টিয়া শহরের তিনতলা ওই ভবনটির দোতলা ও তিনতলায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকেন। বাসার নিচতলায় অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করা হয় বলে মেসের দুজন শিক্ষার্থী বলেছেন। তারা জানান, বাসাটির মালিক আলমডাঙ্গার সাবেক পৌর মেয়র। তিনি মারা গেছেন। উনার মেয়ে এখন এই ভবনটা দেখাশোনা করে। কাপড়ের বিজনেস এবং আত্মীয়দের থাকার কথা বলে পাশের বাসার একজন ব্যক্তি রোজার ঈদের পর এই বাসাটি ভাড়া নেন। আগে প্রায় এক বছর খালি ছিল। বাসায় কিছু সংস্কার কাজ করা হয়েছে। ভেতরের দরজাটি সবসময় বন্ধ থাকে। বাইরে দরজা দিয়েই সবাই যাতায়াত করে। সামনে একটা সিসি ক্যামেরাও লাগানো হয়। সেই ক্যামেরাটি মনিটর ছিল পাশের একটি বাসায়, সেটিও একটি তিনতলা ভবন। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বাসাটি ভাড়া নিয়েছেন তাদের বাসায়।

মেসের একজন শিক্ষার্থী বলেন, এটা আগে ফাঁকা ছিল। পিছনের বাসার এক নারী এসে এই বাড়িটি ভাড়া নেন। দেড়দুই মাস আগে সেটি ভাড়া নেওয়া হয়। ভেতরে কয়জন থাকত তাও জানি না। হয়ত তিনচারজন। এখানে যারা থাকতেন তারা খুব একটা বের হতেন না। কয়েকদিন আগে খুব ভাল স্বাস্থ্যের ও মুখে দাঁড়িওয়ালা একজনকে গামছা রোদে দিতে দেখি। তিনি খুব অল্প সময় বাইরে ছিলেন। তারপর আমাদের দেখে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপর আমি একদিন টিউশনি থেকে বাসায় ফেরছি তখন দেখি, ২০ দিন আগে হবে, একদিন এক সুন্দরী নারী বাইরে কাপড় নাড়ছেন। তিনিও সেখানে ছিলেন। পরে আর দেখিনি। সবারই চলাফেরা ছিল সীমিত। তারা থাকার সময় আমরা আগে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই চলছিল। কোনো পরিবর্তন ছিল না।

সুব্রত বাইনকে যে বাসা থেকে আটক করা হয়েছে, ঠিক সেই ভবনের পেছনেই রয়েছে আরেকটি তিনতলা ভবন। সেই ভবনের মালিকই মূলত নিচতলার বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাসাটির মালিক হেলাল উদ্দিন। তিনি দীর্ঘদিন প্রবাসী ছিলেন। তার স্ত্রী মিনারা খাতুনও সেই বাসায় থাকেন। মিনারা পোশাকের ব্যবসা করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩০ মণের সাদা পাহাড়, দাম চাইলেন ১২ লাখ টাকা
পরবর্তী নিবন্ধচসিকের অনুমতি ছাড়া রাস্তা খুঁড়লে ব্যবস্থা