বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হার বিশ্বে এখন সর্বোচ্চ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত বুধবার দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে (৩০ সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের স্থিতি ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বর শেষেও বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি ছিল। এর মধ্যেই ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে তা নজিরবিহীন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের যে হার, সেটি এখন গোটা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এমনকি কোনও দেশের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশের বেশি পাওয়া যায়নি। গত কয়েক বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দায় থাকা দেশগুলোর খেলাপি ঋণের হারও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত দেড় দশকে আওয়ামী সরকারের আমলে অনিয়ম–দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ খেলাপি হওয়ার পাশাপাশি ঋণ গণনার নীতি পরিবর্তন, সুদহার বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে খেলাপি ঋণ এতটা বেড়েছে।
বলা যায়, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে ব্যাপক পর্যায়ে চলে গেছে। মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৬ শতাংশ এখন খেলাপি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত এক বছরে বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। খেলাপি ঋণের উচ্চহার অর্থনীতি ও ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম গত ২০ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে তাঁর কলামে লিখেছেন, খেলাপিঋণ সংকটের সমাধান চাইলে ট্রাইব্যুনাল অপরিহার্য। তিনি বলেছেন, ঋণখেলাপি সংকটের সমাধান চাইলে অবিলম্বে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপির দ্রুত বিচারের জন্য তিন/চারটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এই প্রস্তাবটি ১৯৯৮ সালে দিয়েছিলেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁর প্রদত্ত বিআইবিএম এর ‘প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায়’। ১৯৯৯ সালে ‘দ্বিতীয় নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায়’ একই দাবি উত্থাপন করেছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় জ্ঞানতাপস আরেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি ও দীর্ঘসূত্রতা সম্পর্কে তাঁদের চাইতে বেশি আর কে জানতো? তাঁদের ঐ প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি তখনকার হাসিনা সরকার। পরবর্তীতে গত সাতাশ বছর ধরে আমি এই দাবিটি বারবার তুলে ধরা সত্ত্বেও কোন সরকারই এ–ব্যাপারে কিছুই করেনি। সরকার ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. আহসান মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ করার পনেরো মাসের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেও খেলাপিঋণ সমস্যার কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা যায়নি। বরং, এখন আগের মত খেলাপিঋণ লুকিয়ে ফেলার অপতৎপরতা আর না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ক্লাসিফাইড লোনের অনুপাত বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে এই অনুপাত ৪০ শতাংশ অতিক্রম করলেও আমি অবাক হবো না। তবুও সরকারের টনক নড়ছে না কেন সেটাই প্রশ্ন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর খেলাপিঋণ আদায়ের জন্য যে টাস্কফোর্স গঠন করেছেন সেটা সফল হতে হলে ট্রাইব্যুনাল গঠনকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতেই হবে, নয়তো তাদের ব্যর্থতা অবধারিত। আমার প্রস্তাব, বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর ক্লাসিফাইড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করে থাকে তার অংশ হিসেবে বিভিন্ন আদালতে মামলার বিষয়বস্তু হিসেবে কত খেলাপিঋণ আটকে রয়েছে তার সর্বশেষ হিসাব এবং কত খেলাপিঋণ ‘রাইট–অফ’ করা হয়েছে তারও সর্বশেষ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হোক।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, খেলাপি ঋণের সঙ্গে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সম্পর্কটা অত্যন্ত নিবিড়। বাংলাদেশের সব ব্যাংকেই কমবেশি খেলাপি গ্রাহক থাকলেও বিদেশি ব্যাংকে কম, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে বেশি। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের দায়ও অনেকখানি। বিগত সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার পেছনে ব্যাংক লোপাট করা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর দায় কোনো অংশে কম নয়। তাই শীর্ষ ঋণখেলাপিদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।






