আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা। প্রতিদিন দেশের কোথাও–না কোথাও ঘটছে শিশুর প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুর নৃশংসতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে এসব অবুঝ শিশু। গত ৫ মে দৈনিক আজাদীতে ‘৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের জন্য শিশুকে নির্দয়ভাবে খুন’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরীর চান্দগাঁওয়ের পশ্চিম মোহরা এলাকায় মুক্তিপণের জন্য প্রতিবেশী যুবকের হাতে খুন হয়েছে মো. শফিউল ইসলাম রহিম (১১) নামে এক শিশু। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর গত বুধবার রাত ৩টার দিকে পার্শ্ববর্তী একটি নির্মাণাধীন বাড়ির রুমের মাটি খুঁড়ে তার মরদেহটি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রতিবেশী ওই যুবক ও তার বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খুনের শিকার রহিম ওই এলাকার সেলিম উদ্দিনের ছেলে। সে পশ্চিম মোহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন চান্দগাঁও থানার কাপ্তাই সড়কর চাঁন মিয়া ফকিরের বাড়ির মৃত আবুল কালামের ছেলে মো. আজম খান (৩২) ও পাঁচলাইশ থানার বিবিরহাট এলাকার মো. ইউসুফের ছেলে মুজিবুর দৌলা হৃদয় (২৮)। আজম খানকে নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে এবং তার সহযোগী মুজিবুর দৌলা হৃদয়কে বলীরহাট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চান্দগাঁও থানার ওসি খায়রুল ইসলাম আজাদীকে জানান, আজমের সঙ্গে সমপ্রতি তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। এরপর আজম মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে। সেই সংকট কাটাতে বন্ধু হৃদয়কে নিয়ে সে শিশু রহিমকে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করে। কিন্তু মুক্তিপণ না পেয়ে রহিমকে নির্মাণাধীন ওই ভবনে নিয়ে কাঠের বাটাম দিয়ে মাথায় ও মুখে আঘাত করে হত্যা করে। এরপর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে সেখানে একটি গর্ত করে মরদেহ ইট ও বালি চাপা দেয়।
শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের দেখলে এক ধরনের মায়া জন্মে। জগতের অন্য অনেক না পাওয়া, হতাশা ভুলিয়ে দেয় শিশুর নিষ্পাপ মুখ, তার অমলিন হাসি। সেই শিশুরা যখন নির্মম নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়–এরচেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। আর এ ধারণাই অপরাধীদের শিশুদের ওপর পাশবিক আচরণের অভয় দেয়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে। এ মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনো বিচারাধীন। এছাড়া যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ ধরনের নির্যাতনের মামলাগুলোর মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্নভাবে বেরিয়ে গেছে। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক। শিশুরা নিরীহ ও দুর্বল। এ জন্য সহজেই তারা টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তারা বিচার চাইতে পারে না। শিশু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার এটিও বড় কারণ। যে হারে শিশুহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ চলছে সেটা যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য অশনি সংকেত। একটি সভ্য সমাজ এভাবে চলতে পারে না।
আসলে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা অমানবিক। এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, আমাদের সমাজেই শিশুর প্রতি সহিংসতার নানা উপাদান রয়েছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে কঠিন আইন আছে। কিন্তু কঠোর আইনই শুধু অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয়। সমাজ যদি অপরাধ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তবে যতো কঠোর আইনই থাকুক না কেন শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বড় ধরনের সঙ্কট দূর করা অসম্ভব।