শিশু হত্যার ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে

| শুক্রবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

শিশু হত্যার ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় চলছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়ার কাছে পড়াতে নিষেধ করার ক্ষোভ থেকে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন তার বাবা শামীম আহমদ। ওই ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল। ময়নাতদন্ত শেষে শিশু মুনতাহার লাশ দাফন করা হয়েছে। মুনতাহার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে বাড়িতে নিয়ে গেলে সেখানে আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে উপস্থিত এলাকার শত শত লোকজন এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান। পরে জানাজা শেষে বাদ আসর মুনতাহার লাশ বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করা হয়। শামীম বলেন, আমার মেয়ের এক সময়ের গৃহশিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে মেয়েকে তার কাছে পড়াতে নিষেধ করি। এতে সে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুনতাহাকে মার্জিয়া ও তার মা আলিফজান কৌশলে তাদের বসতঘরে নিয়ে যায়। পরে তার মুখে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর লাশ বস্তাবন্দি করে ঘরের মধ্যে রেখে দেয়। গভীর রাতে তারা আমার মেয়ের লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে ঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুঁতে রাখে। তিনি বলেন, মুনতাহা নিখোঁজের পর একাধিকবার মার্জিয়াসহ তার পরিবারের কাছে আমার মেয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু তারা একেকবার একেক ধরনের কথা বলতে থাকে। পরে মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে শনিবার রাতে পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। তিনি বলেন, মার্জিয়াকে থানায় নেওয়ার পর তার মা আলিফজান মুনতাহারের পুঁতে রাখা লাশ তুলে পাশের বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় আলিফজানকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান ও তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে আঁতকে ওঠার কথা। শিশু হত্যার এমন ঘটনা শিউরে ওঠার মতোই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা। প্রতিদিন দেশের কোথাওনা কোথাও ঘটছে শিশুর প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুর নৃশংসতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির দ্বন্দ্বেও খুন হচ্ছে এসব অবুঝ শিশু। অত্যাধুনিক এই সমাজব্যবস্থায় শিশু হত্যা ও শিশুর ওপর নির্যাতন আমাদের মনুষ্যত্বকে আজ প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। দেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছে না শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা।

আমাদের সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, যেটি শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হওয়ার কথা, নিজ ঘর; সেটিও এখন আতঙ্কের জায়গা হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি জরিপে যে তথ্য উঠে এসেছে যে ‘নিজ ঘরেই ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর ওপর এ নির্যাতন চালানো হয়। ঘরের বাইরেও শিশুরা মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশুশ্রমে লঙ্ঘিত হচ্ছে অধিকার। পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল মাধ্যম শিশু নিপীড়নের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।’ জরিপে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কাজের জায়গা কিংবা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিশু যতটা নির্যাতিত হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নিজ গৃহে। প্রতিবন্ধী শিশুরা শুধু প্রতিবন্ধকতার কারণে পরিবারে ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, পরিবারে নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে এবং ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছেলে। শিশুদের ৫৫ শতাংশ জানিয়েছে, তারা পরিবারের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। গৃহে ৫০ শতাংশ মেয়েশিশু এবং ৬০ শতাংশ ছেলেশিশু যৌন হয়রানির শিকার। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের নির্যাতনের পরিমাণ ৮২ শতাংশ। ঘরের বাইরে ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অনৈতিক জীবনযাপন, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভলালসা, সামাজিক অস্থিরতা বাবামায়ের হাতে শিশু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। এধরনের শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা অমানবিক। এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। শিশু হত্যার মতো সকল ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে