গত তিন দশকেরও বেশি সময়ে বিশ্বব্যাপী শিশু-স্বাস্থ্যে যথেষ্ট উন্নতিসাধন ঘটেছে। বেড়েছে ১৫ বছরের কম বয়সীদের বেঁচে থাকার হার। যদিও এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ, বা এক দেশ থেকে আরেক দেশে শিশু মৃত্যুর হার-এর পার্থক্য এখনো বিশাল।
দারিদ্র্যতা, মায়েদের শিক্ষার স্তর, পারিবারিক ঝগড়া-বিবাদ, অপুষ্টি, নিরাপদ পানির অভাব, খাদ্য ও স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সেবা-এসবে নিহিত আছে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণসমূহ। এই সময়ে সংক্রমণজনিত কারণে শিশু মৃত্যুর হার বেশ নিম্নগামী। শিশু মৃত্যুর একটা বিরাট অংশ হলো নবজাতক শিশুর মৃত্যু, যা নবজাতক শিশুর সঠিক যত্ন পরিচর্যার মধ্য দিয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব।
অনূর্ধ্ব ১৫ শিশু মৃত্যু ১৯৯০ সালে ছিল প্রায় ১৪.২ মিলিয়ন। তা প্রায় ৫৬ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২০১৮ তে ৬.২০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। এসব শিশু মৃত্যুর প্রায় ৮৫ শতাংশ (৫.৩ মিলিয়ন) ঘটেছে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুতে। আবার ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর প্রায় ৪৭ শতাংশ (২.৫ মিলিয়ন) ঘটে নবজাতক বয়সে, অর্থাৎ জন্মের প্রথম চার সপ্তাহ বয়স কালে।
অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ নানা সংক্রামক রোগ-ব্যাধি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং ম্যালেরিয়া। অনূর্ধ্ব ৫ শিশু বয়সে এই তিনটা রোগ যৌথভাবে এক তৃতীয়াংশ শিশুমৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এককভাবে এক তৃতীয়াংশ শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করে অপুষ্টি সমস্যা।
যদিও অনূর্ধ্ব ৫ শিশুদের কেবল ৫২ শতাংশ বাস করে সাব-সাহারার আফ্রিকা এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াতে। কিন্তু শিশু মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশ ঘটে কেবল এই দুই অঞ্চল মিলে। পৃথিবীতে প্রায় অর্ধেকের বেশি শিশু মৃত্যু ঘটে মাত্র পাঁচটা দেশ মিলিয়ে, যথা-ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান এবং ইথিওপিয়া।
শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে যেসব কারণে-
দারিদ্র্যতা এবং সামাজিক কারণে দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো
শিক্ষিত মায়ের সন্তানের মৃত্যুঝুঁকি কম হয় বলে প্রমাণিত
মানসম্মত স্যানিটেশন এর অভাব এবং অনিরাপদ পানি- শিশু বয়সে ডায়রিয়া ও রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়
সুষম খাদ্যের অভাবে- শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, ঘন ঘন অসুখে আক্রান্ত হয় বিশেষত সংক্রমণজনিত অসুখে। এবং দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টিতে ভোগা শিশু পরবর্তীতে খর্বকায় হয়
ঘরবাড়ির দুরাবস্থা, বায়ুদূষণ এবং শহরতলীর ঘিঞ্জি পরিবেশ শিশু বয়সে শ্বাসতন্ত্রের নানা সংক্রামক অসুখের জীবাণু ছড়াতে সাহায্য করে
শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ
অপি্রতুল মেডিক্যাল কেয়ার- যেসব স্থানে সুদক্ষ চিকিৎসক ও নার্সের অভাব রয়েছে, সেখানে শিশু প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়
ভৌগলিক অবস্থান- কোনো কোনো অঞ্চলে নির্দিষ্ট কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব থাকে, যে কারণে সেসব অঞ্চলে শিশু মৃত্যুর হার বেশি হয়ে থাকে। যেমন- যেমন, ম্যালেরিয়ার কারণে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়াতে শিশু মৃত্যু বেশি
টিকাদান, ওষুধযুক্ত মশারির ব্যবহার শিশু মৃত্যু হ্রাসের অন্যতম উপায়। যেখানে এসবের ঘাটতি রয়েছে সেখানে শিশু মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।
শিশু স্বাস্থ্য ঝুঁকির নতুন কারণসমূহ-
এর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছূ অসংক্রামক কিছু রোগ। যেমন-
ক্যানসার, রক্ত সরবরাহ তন্ত্রের অসুখ, দীর্ঘ মেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের অসুখ এবং ডায়াবেটিস। যেগুলো অধুনা নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে যেসব ফ্যাক্টর চিহ্নিত হয়েছে সেসব হলো- অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ যাতে করে শিশু স্থূলদেহী হয়ে পড়ে। অন্যান্যের মধ্যে রয়েছে-তামাকের ব্যবহার, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদকাসক্তি, শিশুদের কায়িক পরিশ্রম বা শরীর চর্চা র প্রতি অনীহা ও বায়ু দূষণ
দুর্ঘটনাজনিত ইনজুরির কবলে পড়ে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে শিশু প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে
শিশুবয়স ও বয়সন্ধিকাল মিলিয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত। বর্তমান সময়ে বয়সন্ধিকালে ছেলে সন্তানদের মধ্যে সুসাইড প্রবণতার আধিক্য দেখা যায়।
শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পদক্ষেপসমূহ-
ফ্যামিলি প্ল্যানিং- ১৮ বছরের আগে গর্ভধারণ না করা এবং পরবর্তীতে তিন বছরের বিরতি দিয়ে গর্ভধারণ
মায়ের পুষ্টি, গর্ভপূর্ব সময়কাল থেকে মাকে ফলিক এসিড সেবন, গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা
গর্ভবতী মায়ের সঠিক যত্ন, নিরাপদ প্রসব ও নবজাতক সন্তানের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত
শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধে তাকে সময়মত ও নিয়মিত টিকদান। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হুপিং-কাশ, হিব্্, পিসিভি ও হামের টিকা। শিশু মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে তৎক্ষণাৎ নির্ণয় করে এন্টিবায়োটিক প্রদান এবং হাসপাতালে রেফার করা
শিশু বয়সে ডায়রিয়া প্রতিরোধে নিরাপদ পানি, যথাযথ স্যানিটেশন এবং হাইজিন এর ব্যবস্থা থাকা। ডায়রিয়া শুরুর প্রথম থেকে শিশুকে মুখে খাবার স্যালাইন খাওয়ানো এবং স্বাভাবিক খাবার-দাবার চালিয়ে যাওয়া। শিশু খুব অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তিপূর্বক চিকিৎসা করানো
অপুষ্টি প্রতিরোধে- ঘরে সুষম খাবার যোগানো, স্কুলে খাবার সরবরাহ, নিয়মিতভাবে কৃমিনাশক ওষুধ সেবন, শিশুকে যথযথভাবে বুকের দুধ পান এবং জিংক প্রদান
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ওষুধযুক্ত মশারির ব্যবহার, মশার উৎপত্তি স্থল ধ্বংস করা
শিশুর যক্ষ্মা নিরোধে শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বিসিজি টিকা দান। বয়স্ক যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা
এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে পিএমটিসিটি পদক্ষেপ গ্রহণ
শিশুর সার্বিক ব্যবস্থাপনায়-আইএমসিআই গাইডলাইন অবলম্বন করা।
উপসংহার: এসডিজি ২০৩০ লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিশু-স্বাস্থ্যের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।