বইমেলায় শিশু কর্নার। আলাদা গেট দেয়া হয়েছে। তাই দূর থেকে সহজে চোখে পড়ে। কিন্তু কাছে যেতেই সৃষ্টি হয় বিভ্রম। কারণ গেট পার হলেই দেখা যাবে, শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড। যেন মিনি ‘শিশু পার্ক’ এটি। সেখানে আবার উচ্চ ভলিউমে বাজছে হিন্দিগান!
এ দৃশ্য নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলমান বইমেলার। এতে পাঠক, লেখক, দর্শনার্থী সবাই বিরক্ত ও অতিষ্ঠ। বিশেষ করে শিশু কর্নার গেটের আশেপাশে যেসব প্রকাশনা সংস্থার স্টল রয়েছে সেসব প্রকাশক ও তাদের বিক্রয়কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, উচ্চ স্বরে গান বাজানোয় মেলার স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটছে। হচ্ছে শব্দ দূষণ। এতে পাঠক তাদের স্টলমুখী হচ্ছেন না। অনেকে ভাষার মাসে বিরতিহীন হিন্দি গান বাজানো নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। সব প্রশ্নের ভিড়ে আলোচনায় এসেছে, বইমেলার শিশু কর্নারে থাকবে শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশ করে এমন প্রকাশনা সংস্থার স্টল। যে কর্নারে এসে শিশুরা হারিয়ে যাবে তাদের উপযোগী লেখা বইয়ের জগৎ–এ। সহজে খুঁেজ নিবে পছন্দের বই। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম কেন হবে? ‘শিশুপার্ক’ কেন গুরুত্ব পাবে বইমেলায়?
শিশু কর্নার গেট এর ভেতর মিনি ‘শিশু পার্ক’ গড়ে তোলা হলেও গেটের একপাশে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি শিশুদের বই প্রকাশ করে এমন প্রকাশনা সংস্থার স্টল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– নন্দন প্রকাশন, কিডস পাবলিকেশন্স, কথা বিচিত্রা প্রকাশনী, শালিক প্রকাশন, জনতা প্রকাশন, ঝিলমিল, ফুলঝুরি, রানা প্রকাশনী, শিশু কিশোরদের বইয়ের ভুবন এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। তবে গেটের অপর পাশে রয়েছে সত্যায়ন প্রকাশন। ধর্মীয় লেখকদের বই বিক্রি হয় এ প্রকাশনা স্টল থেকে। সত্যায়নের পাশে আছে শিশুদের প্রকাশনা আদিগন্ত প্রকাশন। শালিক প্রকাশন এর স্বত্ত্বাধিকারী আখতারুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, শিশু মনন, শিশু প্রকাশ, রং পেনসিল, বাবুইসহ অনেক প্রকাশনা রয়েছে যেগুলো শিশুদের বই বিক্রি করে। শিশু কর্নারে তাদের স্টল নেই। স্টল বরাদ্দের বিন্যাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত ছিল। শিশু কর্নারের আড়ালে ‘শিশু পার্ক’ করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সেখানে হিন্দি গান চলছে। অমর একুশে বইমেলায় হিন্দিগান বাজানো কাম্য নয়। তাছাড়া সব সময় গান বাজানোর কারণে শব্দ দূষণও হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে পাঠকরা আসতে অস্বস্তিবোধ করছেন।
নন্দন প্রকাশন এর প্রতিনিধি রওনক আজাদীকে বলেন, সারাক্ষণ হিন্দি গান বাজছে শিশু কর্নারের নামে করা ‘শিশু পার্কে’। এটা খুব বাজে ব্যাপার। বইমেলার শিশু কর্নারে কী শিশু পার্ক হয়? আবার সেখানে চলছে হিন্দি গান! ভাষার মাসে বইমেলার মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উচ্চশব্দে হিন্দি গান মেনে নেয়া যায় না।
গত কয়েকদিন ঘুরে দেখা গেছে, বইমেলা মঞ্চে যখন আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে তখনও চলে হিন্দিগান। আবার বইমেলা মঞ্চের একদম কাছেই রয়েছে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের স্থান। সেখানেও ব্যবহার হয়েছে মাইকের। অর্থাৎ একই সময়ে মেলা প্রাঙ্গণের কাছাকাছি তিনটি স্থানে মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার হচ্ছে। এতেও বিরক্তি প্রকাশ করেন অনেকে।
চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন’র স্বত্ত্বাধিকারী চৌধুরী ফাহাদ আজাদীকে বলেন, মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। শিখা প্রকাশনীর প্রতিনিধি হারুনুর রশীদ আজাদীকে বলেন, মাইকের আওয়াজ আরেকটু নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
চন্দ্রবিন্দু এর প্রতিনিধি জুঁই আফরিন আজাদীকে বলেন, গতবারের চেয়ে বেচাকেনা কম। যাতায়াত সমস্যা। জিমনেশিয়াম মাঠে (গতবারের মেলার স্থান) অনুষ্ঠিত বইমেলায় লোকজন বেশি আসে সন্ধ্যায়। নিরাপত্তাজনিত কারণে এসময়ে সিআরবিতে লোকজন কম আসছে। বিশেষ করে মেয়েরা। জিমনেশিয়ামে রাতেও মেয়েদের উপস্থিতি থাকত। এখানে সন্ধ্যা হলে ফিরতে চায়। বের হয়ে রিকশাও পাওয়া যায় না। আসার গাড়িভাড়াও বেশি খরচ হয়। তার অভিযোগ, বইমলার প্রচারণা কম হচ্ছে। প্রচারণা হচ্ছে কেবল সাত রাস্তার মোড়ে। অথচ ওখানে আসলে মেলা চোখে পড়ে। তাই শহরে আরো প্রচারণা বাড়ানো উচিত। বাণিজ্যমেলা নিয়ে মোড়ে মোড়ে মাইকিং হচ্ছে। বইমেলা নিয়েও হওয়া উচিত।
নতুন বইয়ের খবর :
বইমেলায় আসা নতুন বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– মহীবুল আজিজ এর কাব্যগ্রন্থ ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’, কামরুল হাসান বাদলের গল্পগ্রন্থ ‘খুন ও হুইসেল’, জয়নুল টিটো‘র থ্রিলার উপন্যাস ‘পয়েন্ট ওয়াই’, হিমেল মাহমুদ এর গল্পগ্রন্থ ‘লাল প্রাইভেটকার’ ও রেহানা পারভীনের ‘জনক সমাচার’।
‘একে একে হারিয়ে যাওয়া লোকগুলো কোথায় যায়? নাকি পালায়? মানুষ পালায় কেন? কীসের তাড়নায়? বিদেশপড়ুয়া সোমত্ত, যুবক সামিরইবা পালাল কেন? চৌকস ওসি রফিক যেখানে ব্যর্থ, সেখানে পিবিআই ইন্সপেক্টর রাজনের সফলতার টোটকা কি ওই এফোর সাইজ? শৈশবে ঘরপালানো নওশাদ মিয়া জীবনসায়াহ্নে এসে কেনইবা আবার পালিয়ে যান?’ এসব কেন এর উত্তর মিলবে জয়নুল টিটো‘র উপন্যাস ‘পয়েন্ট ওয়াই’ এ।
‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই পাহাড়ি জনজীবন আশ্রিত। বিশেষত বান্দরবানের পাহাড়, ঝর্ণা, ঝিরি, জুমের নিভৃত অঞ্চল এবং সেখানকার সরল নিরাভরণ বিচিত্র নৃগোষ্ঠীর জীবন যাপন উঠে এসেছে।’ মহীবুল আজিজ আজাদীকে বলেন, গঙখাঙ রেগেখ্যঙ মানে আকাশ ও শক্সখ নদী। মারমা জীবনের আকাশ অনেক বিস্তৃত এবং নদীও অনেক চঞ্চলা। সমতলের সুলুকসন্ধান স্বার্থের ছোটাছুটি এইসবের বাইরে কেবলই বিকশিত হওয়া গোত্রবদ্ধ জীবনের জলছবি কবিতায় মূর্ত হয় নানা মাত্রায়। হয়ত কবিতার চেয়ে জীবন আরো অনেক বিশাল, তবু শেষপর্যন্ত কবিতার সীমাবদ্ধ জগতেই বিশালতাকে ধরার প্রচেষ্টা নিতে হয়।
কামরুল হাসান বাদলের গল্পগ্রন্থ ‘খুন ও হুইসেল’ সম্পর্কে কবি হোসাইন কবিরের মূল্যায়ন হচ্ছে– ‘খুন ও হুইসেল গল্পটি নিছক কোনো গল্প নয়। বরং এটি নিকট অতীতের ঐতিহাসিক সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটি দলিল। এতে জেনেভা ক্যাম্পে জন্ম নেয়া মাস্তান শামসুর চরিত্রই চিত্রায়ণ করা হয়নি, বরং এ চরিত্রকে উপলক্ষ্য ধরে গল্পের বুননে উঠে এসেছে আমবাগান ও তৎসংলগ্ন এলাকার বাঙালি–বিহারির সামাজিক–রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বিরোধের নানামুখী বিষয়ের অনুপুক্সখ বর্ণনা; সামপ্রতিক সময়ের ক্ষমতা বিস্তারের দলীয় রাজনীতির আচরণগত বিষয়টিও এতে তুলে ধরা হয়েছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বইমেলায় এসেছে ১৬টি গল্পের সংকলন ‘লাল প্রাইভেটকার’। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশন এর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে গল্পগ্রন্থটি। প্রথম দিনেই বইটি নিয়ে পাঠকের মাঝে আগ্রহ দেখা গেছে। এর লেখক হিমেল মাহমুদ। এটি সাংবাদিক মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ’র ছদ্মনাম। ‘লাল প্রাইভেটকার’ নিয়ে কবি আকবর চৌধুরীর মূল্যায়ন হচ্ছে– ‘গ্রন্থভুক্ত সবগুলো গল্পই মনুষ্যজীবনের নানা ডাইমেনশন ও চরিত্র নিয়ে লেখা। গল্পের বাঁকে বাঁকে দেখা মেলে ভালো–মন্দ, আনন্দ–বিষণ্নতা, সত্য–মিথ্যা, কৃতজ্ঞতা–কৃতঘ্নতা, উল্লাস–হাহাকার এসব নানা অনুষঙ্গের। গল্পগুলোর কোনোটিতে উঠে এসেছে একান্নবর্তী পরিবারে বসবাসের স্বর্গীয় সুখ, গ্রামীণ নৈসর্গিক রূপ কিংবা নাগরিক জীবনের হাজারো বিড়ম্বনা। রয়েছে চিরকালীন প্রেম–অপ্রেমের কথা, বিরহ–বেদনার কথা। কোনো কোনো গল্পে রয়েছে নিছক হাস্যরস, কোথাও অবধারিতভাবে চলে এসেছে আদিম ও অকৃত্রিম কামনা–বাসনার কথাও।’