শিশু অধিকার রক্ষায় সমাজে সকল শ্রেণির মানুষকে এক হতে হবে

| শনিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

আমরা সব সময় বলি, শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু বড় হয়ে তার উদ্দীপ্ত ও সৃষ্টিশীল চিন্তার মাধ্যমে আগামীদিনের বিশ্বকে আজকের চেয়ে তারও সুন্দর, সংঘাতহীন ও উন্নত করে তুলবে। তাই শিশুকে সেভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে অভিভাবকদের। শিশু অধিকার রক্ষায় সমাজে সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে একত্রিত করে এবং জাতীয় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সকল পর্যায়ে সব ভেদাভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে।
সামাজিক জীবনে শিশুরা এখনো অবহেলিত। সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা, বেড়ে ওঠার নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রে এরা বৈষম্যের শিকার প্রতিনিয়ত। হুমায়ুন আজাদ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, এর অনেক শত্রু। কোনো সমাজ ওর চোখ অন্ধ করে দিতে চায়। কোনো সমাজ ওর পা খোঁড়া করে দিতে চায়। কোনো সমাজ ওর কান বধির করে দিতে চায়। আরবে অনেক আগে মেয়েদের জীবিত কবর দেয়া হতো। একটি মেয়ে যেই জন্ম নিতো, সারা বাড়িতে শোকের ছায়া নামতো। এখনো আমাদের দেশে অনেক বাড়িতে মেয়ে জন্ম নিলে সবাই দুঃখ পায়। চীনে এ সময় মেয়েদের শিশু বয়স থেকেই পরিয়ে রাখা হতো কাঠের জুতো। ওরা হাঁটো পারতো না। কোনো কোনো দেশে ছেলেরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো, বিধাতা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে মেয়ে করোনি বলে। মেয়ে হওয়ার থেকে পশু হওয়াও ভালো। আর মেয়েরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো, বিধাতা তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে তুমি যা করেছ, তার জন্যই তোমাকে ধন্যবাদ।
শিশুকাল থেকে মেয়েরা পীড়নের শিকার। ও মেয়ে বলে ওকে বঞ্চিত করা হয় ভালো খাবার থেকে, ভালো পোশাক থেকে। ও মেয়ে, তাই ওকে সব সহ্য করতে হয়। ও শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই তার প্রতিবাদ চলে না। শরীরই যেন ওর নিয়তি। ও ভয় পায়, ওকে ভয় দেখায়। হাজার বছর ধরে চলছে ওর ওপর অত্যাচার। এতো বঞ্চনা, এতো লাঞ্ছনা সত্ত্বেও ও এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। পৃথিবীতে চিরকাল ধরে চলছে শোষণ। শক্তিমান শোষণ করে দুর্বলকে, ধনী শোষণ করে গরিবকে, আর সবাই শোষণ করে ওকে। ও মেয়ে। পৃথিবীতে ও সবচেয়ে শোষিত। পৃথিবীতে বহু মানুষের স্বাধীনতা নেই। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতাহীন হচ্ছেও। কারণ ও মেয়ে।
এখন সেই মেয়ের অধিকার এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের অর্থাৎ অভিভাবকদের। ও পৃথিবীর অর্ধেক, সভ্যতার অর্ধেক। সভ্যতার অর্ধেক ওর সৃষ্টি। ভবিষ্যৎ সভ্যতার বড়ো অংশ সৃষ্টি হবে ওর প্রতিভায়। এতো দিন মানুষ কাজে লাগিয়েছে তার অর্ধেক প্রতিভা, অর্থাৎ ছেলেদের প্রতিভা। ভবিষ্যতে মেয়ে আর ছেলের মিলিত প্রতিভায় বিকশিত হবে মানুষ। পৃথিবী হয়ে উঠবে আরো সুন্দর, আরো কল্যাণময়।
ছেলে ও মেয়ের মধ্যে এই যে বৈষম্য সমাজে লক্ষ্য করা যায়, তা দূর করতে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে মা ও বাবাকে। এর পর পরিবারে অন্য অগ্রজ কাউকে। শিশুকাল থেকেই যদি ছেলে শিশু ও কন্যা শিশুর মধ্যে ব্যবধান দূর করা যায়, যদি তাদের বোঝানো যায় যে তারা সবাই একই পরিবেশে একই মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তাহলে এর ফল গ্রহণ করবে সমাজ। সৌভ্রাতৃত্ব, সহধর্মিতা, সহমর্মিতা ও বোঝাপড়ার অগ্রগতি সাধনের মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত। এই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে মা-বাবাকে।
আমরা প্রত্যক্ষ করি, সামাজিককরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুর মনে নারী ও পুরুষের বোধ তৈরি করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বৈষম্য ও মানসিকতা দূর করা যাবে না তাড়াতাড়ি। তারজন্য প্রয়োজন মনোগত উন্নয়ন। এই মনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে একমাত্র অভিভাবকরাই। পড়াশোনায়, খাবারে দাবারে, আচার ব্যবহারে তারা ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুর মধ্যে সমতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে সমতার উন্নয়নের মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে সম্পর্ক। সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে পারে উদার মনোভাব। এই মনোভাব তৈরিতেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেন অভিভাবকরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই দিনে
পরবর্তী নিবন্ধনৈতিকতা ও অনৈতিকতা