আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা। প্রতিদিন দেশের কোথাও–না কোথাও ঘটছে শিশুর প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুর নৃশংসতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সম্পত্তির দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে এসব অবুঝ শিশু। বলা যেতে পারে, শিশুদের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের সহিংসতা লেগেই আছে। নির্যাতনের ধরন আর নৃশংসতা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বড় মানুষকে পিটিয়ে লাশ করা হয়, তখনও কিছুই হয় না। শিশুদের ওপর চরম অত্যাচার চললেও কিছু হয় না। গবেষকরা বলেন, যে দেশে শিশুদের সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর সেরা আইন আছে, যে দেশে স্কুলে–মাদ্রাসায় শিশুর গায়ে হাত তোলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ, সে দেশেই শিশুরা মার খাচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, বলাৎকারের শিকার হচ্ছে নিজের বিদ্যাপীঠে, কাজের জায়গায়, বাড়িতে, পাড়ায়, চেনাজানা মানুষের হাতে, থানায় ও আদালত চত্বরে। তা নিতান্তই দুঃখজনক।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘শিশুকে গলা টিপে হত্যা, ঘরের ভেতর পাওয়া গেল মরদেহ, ধর্ষণের পর খুনের অভিযোগ’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাকের ও নাজিয়া দম্পতির আট বছরের বিবাহিত জীবন। তাদের একমাত্র সন্তান মারিয়া। নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় গত রোববার সকালে ৭ বছরের শিশু মারিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ উঠেছে এক যুবকের বিরুদ্ধে। পরে রাকিবুল ইসলাম মুন্না (২৪) নামে ওই যুবককে আটক করে পুলিশ। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, শিশুটির বাবা–মা বাইরে থাকায় শিশুটি বাসায় একা থাকত। রোববার সকালেও শিশুটির বাবা–মা কাজে চলে যান। পরে শিশুটির ফুফু ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পান ঘরের মধ্যে এক ভবঘুরে ছেলেকে। একইসঙ্গে শিশুটির হাত–পা বাঁধা এবং পরনের প্যান্ট নেই। পরে ওই শিশুকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসি বলেন, গ্রেপ্তার রাকিবুল পুলিশের কাছে স্বীকার করে, চুরি করতে ওই বাসায় ঢুকেছিল। শিশু মারিয়া চিৎকার করায় তাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। পুলিশের ধারণা, শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এরপর হত্যা করা হয়। তবে ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করে রাকিবুল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মৌলভী পুকুর পাড় এলাকার একটি ভাড়া বাসায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের দেখলে এক ধরনের মায়া জন্মে। জগতের অন্য অনেক না পাওয়া, হতাশা ভুলিয়ে দেয় শিশুর নিষ্পাপ মুখ, তার অমলিন হাসি। সেই শিশুরা যখন নির্মম নৃশংস হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়–এর চেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে তাদের এই অপরাধের কোনো বিচার হবে না। কেননা বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন নজির নেই। আর এ ধারণাই অপরাধীদের শিশুদের ওপর পাশবিক আচরণের অভয় দেয়। এ পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা হয়েছে।
এ মামলাগুলোর অধিকাংশই এখনো বিচারাধীন। এছাড়া যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ ধরনের নির্যাতনের মামলাগুলোর মাত্র ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ মামলায় আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্নভাবে বেরিয়ে গেছে। শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের চলতি ধারাটি উদ্বেগজনক। শিশুরা নিরীহ ও দুর্বল। এ জন্য সহজেই তারা টার্গেটে পরিণত হয়। এছাড়া শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তারা বিচার চাইতে পারে না। শিশু নির্যাতন বন্ধ না হওয়ার এটিও বড় কারণ। যে হারে শিশুহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ চলছে সেটা যে কোনো সুস্থ সমাজের জন্য অশনি সংকেত। একটি সভ্য সমাজ এভাবে চলতে পারে না। সভ্য সমাজে শিশুর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয়; হত্যা, খুন অপহরণ, ধর্ষণ তো দূরের কথা। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও শিশুহত্যা নিষেধ। কিন্তু আমাদের সমাজে কেন এসব ঘটছে সেটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা সম্পূর্ণ অমানবিক। এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।