শিশুসাহিত্য উৎসবের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন

শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন নয়, বই তুলে দিতে হবে : আজাদী সম্পাদক

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে দুদিনব্যাপী বর্ণিল শিশুসাহিত্য উৎসব গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে শুরু হয়েছে। দেশের খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিকদের সরব উপস্থিতিতে উৎসব উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। উদ্বোধকের বক্তব্যে তিনি বলেন, শিশুর প্রতি ভালোবাসা শিশুসাহিত্য রচনার পূর্বশর্ত। শিশু যে কোনো জিনিস দেখলে ধরতে চায়, ছুঁতে চায়। ওরা খেলতে চায়। টেলিভিশন দেখতে চায়। তাদের আগ্রহ ও আনন্দের জায়গাটুকু খবর রাখতে হয় শিশুসাহিত্যিকদের। বলা যেতে পারে, শিশুর মনস্তত্ত্ব আয়ত্ত করে নেওয়া জরুরি। শিশুসাহিত্য যেন শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে ওঠে, তার জন্য ভাবতে হবে শিশুসাহিত্যিকদের।

উৎসবে এম এ মালেক আরো বলেন, শুধু শিশুসাহিত্য নয়, যে কোনো ধরনের রচনার বড় একটি গুণ হলো সহজ ও সরল রচনারীতি। শিশুসাহিত্যে এই সারল্য প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। ইচ্ছে করলেই লেখাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় না। তার জন্যও প্রয়োজন সাধনা। রচনার সহজ রীতির এই বৈশিষ্ট্যটি লেখকের মানসিকতা, উপলব্ধি ও আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। সহজ ও সরল রীতি আয়ত্ত করা কঠিন একটা কাজ। এই কঠিন কাজটি নিজের কব্জায় আনার জন্য প্রয়োজন অনুশীলন। অবিরাম চর্চার মধ্য দিয়ে লেখকরা তাঁদের রচনাকে সরল, সহজ, সরস ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। এম এ মালেক বলেন, ভালো কাজের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাজে আলো বিলিয়ে দিতে হবে। একাগ্রচিত্তে কাজের মধ্যে লেগে থাকতে হবে। তাহলে একদিন সেই কাজে সফলতা আসবে। শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন বাদ দিয়ে বই তুলে দিতে হবে। আজকের এই দুদিনের শিশুসাহিত্য উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তিন শতাধিক লেখক যোগ দিচ্ছেন শুনে ভালো লাগলো। এই উৎসব নিজেদের লেখালেখির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে আশা রাখি।

বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় উদ্বোধন পর্বে বৃন্দ আবৃত্তি পরিবশেন করেন উঠোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের শিশুশিল্পীবৃন্দ। এ পর্বে মো. মাজহারুল হক ও ঢালী মোহাম্মদ শোয়ায়েব নজীরকে বইয়ের পৃষ্ঠপোষক সম্মাননা প্রদান করা হয়।

খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামালের সভাপতিত্বে ‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য : সৃজনে মননে কতটা যুগোপযোগী’ শিরোনামে উদ্বোধনী আলোচনায় অংশ নেন ছড়াকার আনজীর লিটন, কথাসাাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ, সুজন বড়ুয়া, কবি রহীম শাহ। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ।

আলোচক ছড়াকার আনজীর লিটন বলেন, শিশু সাহিত্যই হচ্ছে মূল সাহিত্যের প্রধান অংশ। আর শিশুদের জন্য রচিত সকল সাহিত্য নিটোল সাহিত্য বলে বিবেচিত। তিনি আরো বলেন, শিশুসাহিত্য হলো এমন সাহিত্য যেখানে কোনো কুসংস্কার, কূপমণ্ডকতা থাকতে পারবে না। তাদের জন্য সবসময় যুগোপযোগী সাহিত্য রচনা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আমাদের অনেক সচেতন থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকৃত সাহিত্যিকরা কখনো টিকটকার হতে পারে না।

কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিত চৌধুরী বলেন, আমাদের বাংলা শিশুসাহিত্যের একটা সোনালি অতীত রয়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকে বরীন্দ্রনাথনজরুল, কাজী কাদের নাওয়াজ, বন্দে আলী মিয়া, সুফিয়া কামাল প্রমুখ সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। তিনি আরো বলেন, এখন প্রচুর শিশুসাহিত্য রচনা হচ্ছে কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে কোনো লেখাটি কালোত্তীর্ণ হচ্ছে। সেজন্য আমাদের সময়ের সাথ তাল মিলিয়ে শিশুসাহিত্য রচনা করতে হবে। ভাবনায় থাকতে হবে লেখা যেন ‘কাল’কে ছাড়িয়ে যায়।

কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ বলেন, আমাদের শিশুরা কি চায়, কি ভালোবাসে সে ভাবনা মাথায় রাখতে হবে আমাদের শিশুসাহিত্যিকদের। কারণ শিশুদের জগতটাকে আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, শিশুরা কল্পনায় মাঝে ভাসতে চায়, তাদের ভুবন বিস্তৃর্ণ ও রঙিন। তাই শিশুদের জন্য লিখতে হবে কল্পনা জাগানো এমন লেখা। যেন তারা বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

কবি সুজন বড়ুয়া বলেন, তথ্য প্রযুক্তির প্রবল উৎকর্ষতায় শিশুরা যেন বই পাঠ থেকে বিমুখ না হয় সে লক্ষ্যে অভিভাবকদের সাথে সাথে শিশুসাহিত্যিকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। শিশুদের পরম বন্ধু হিসেবে আমাদের শিশুসাহিত্য রচনা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, শিশুসাহিত্যিকদের পঠনপাঠনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হবে। শিশুসাহিত্যে আমাদের দেশের কথা, মাটির কথা, ইতিহাসের কথা ও আগামীর কথা থাকতে হবে।

সভাপতির বক্তৃতায় মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল বলেন, আজকের এই শিশুসাহিত্য উৎসব কেবল সাহিত্যিক মিলনমেলা নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক গভীর দায়বোধেরও উৎসব। তিনি আরো বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষ যুগে আমরা এমন এক সময়ের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছি, যখন একদম শিশুতোষ কাল থেকে সন্তানের হাতে প্রথম ধরা পড়ে মোবাইল ফোন, বই নয়। মোবাইল স্পর্শের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায় নানা ধরনের ‘সেনসরি ডায়েট’ কিংবা সংবেদী তথ্যউপাত্ত। নেট আসক্তি, গেম, ভিডিও আর ভার্চুয়াল বিনোদনের দৌড়ে শিশুকিশোরেরা ধীরে ধীরে বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, চলুন, শিশুর হাতে আবার বই তুলে দিই। আসুন ঘরে ঘরে নয় কেবল সন্তানের ঘরেও লাইব্রেরি গড়ে তুলি।

উদ্বোধনী ছড়াপাঠে অংশ নেন বিপুল বড়ুয়া, আবুল কালাম বেলাল, এয়াকুব সৈয়দ, কেশব জিপসী, জসীম মেহবুব, সনজীব বড়ুয়া, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার।

দ্বিতীয় অধিবেশনে ছোটোদের পত্রিকা : নতুন সাহিত্য সৃষ্টির উৎসমুখ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এমরান চৌধুরী। আলোচক ছিলেন অমিত বড়ুয়া, আইরীন নিয়াজী মান্না, আখতারুল ইসলাম, আল জাবেরী, ইসমাইল জসীম, মঈন মুরসালিন। সূচনা বক্তব্য দেন শিপ্রা দাশ। এরপর ছোটোদের বইয়ের মান উন্নয়নে লেখক প্রকাশকের দায় শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অভীক ওসমান। আলোচক ছিলেন গোফরান উদ্দীন টিটু, নাফে নজরুল, নাহিদা আশরাফী, মালেক মাহমুদ, মিজানুর রহমান শামীম, স ম শামসুল আলম। সূচনা বক্তব্য দেন রুনা তাসমিনা। এরপর প্রান্তিক জনপদে শিশুসাহিত্যচর্চা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাঈদুল আরেফীন। আলোচক ছিলেন আতিক রহমান, ইলিয়াস বাবর, চন্দনকৃষ্ণ পাল, চন্দ্রশিলা ছন্দা, জাকির হোসেন কামাল, জালাল খান ইউসুফী, মুসতাফা আনসারী, শিবুকান্তি দাশ সূচনা বক্তব্য দেন, নিজামুল ইসলাম সরফী। লেখা পাঠের তিন পর্বে সভাপতিত্ব করেন মর্জিনা আখতার, ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী ও তহুরীন সবুর ডালিয়া।

আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে অধিবেশন শুরু হবে বিকেল সাড়ে তিনটায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপি ক্ষমতায় গেলে ‘রেইনবো নেশন’ গড়বে : ফখরুল
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬