শিশুসাহিত্যের প্রকাশনায় লেখক-প্রকাশকের আরো বেশি মনোযোগ চাই

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৪ মার্চ, ২০২৫ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রকাশনাশিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। একটু যত্নবান হলেই এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা সম্ভব। তবে বইয়ের সংখ্যার চাইতে এর মানের দিকে নজর দেওয়া একজন লেখকের যেমনি প্রয়োজন তেমনি প্রকাশকেরও লক্ষ্য রাখতে হবে।’

প্রকাশনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে গত শতকের নব্বই দশক থেকে এ শিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বদলে দিয়েছে তার ধ্যানধারণা, পরিবর্তন হয়েছে তার পরিবেশ। প্রকাশনার ক্ষেত্রে পেছনের অনেক কাজ কমে গেছে, সময় কম লাগছে। খুব অল্প সময়েই বাজারজাত করা যাচ্ছে উৎপাদিত বই। এতে প্রচুর বই বাজারে আসতে পারছে। প্রকাশনায় এসেছে সৌন্দর্য, বেড়েছে জৌলুশ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মানও বেড়েছে। প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকাশকের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ আগ্রহী হচ্ছেন এ পেশায়। স্বাধীনতার পর নানা সংকট পেরিয়ে প্রকাশনা শিল্প আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ শিল্প বাংলাদেশে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। কিন্তু সেই তুলনায় সাহিত্যের অবস্থান কতটা শক্তিশালী হয়েছে, সেটা ভাববার বিষয়। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের কারণে একটা বই যত তাড়াতাড়ি প্রকাশ সম্ভব, তাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েও অনেকের প্রশ্ন জাগে, প্রকাশিত বইগুলো কতটা সম্পাদিত হয়ে বের হয়? বড়দের প্রকাশনার কথা বাদ দিলাম, কিন্তু ছোটোদের বই! কতটা মানসম্পন্ন আমাদের ছোটোদের প্রকাশনা!

যদিও আমাদের দেশে মান শব্দটা অনেকটাই আপেক্ষিক। মূলত সকল ক্ষেত্রে মান বজায় রাখার ঘাটতিই পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মান বজায় রাখা বিষয়ে উপেক্ষা করাও চলে না। তেমনি একটা ক্ষেত্র হলো বই। একটি ভালো বই হচ্ছে সঠিক পথ চলার বন্ধু। ভালো বই পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। যেহেতু ভালো বই পাঠককে আনন্দ দেয়, দেয় প্রশান্তি, সেহেতু আমাদের চাই মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশ। বইয়ের আবেদন যেহেতু শাশ্বত, সেহেতু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের নজরদারি অত্যাবশ্যক। নিম্নমানের বই এবং বানান ভুলসহ বিভিন্ন প্রকার অসঙ্গতি সকলেরবিশেষ করে শিশুকিশোরদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য। তাই মানসম্পন্ন বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের অভিজ্ঞ সম্পাদকের শরণাপন্ন হওয়া কর্তব্য।

শিশুসাহিত্যের মানসম্পন্ন বই নিয়ে আছে অনেকের অনেক অভিযোগ। বানান ভুল ও ভুল ছন্দে রচিত ছড়াকবিতা আর অসংলগ্ন প্রচ্ছদে ভরা এসব বই শিশুদের উপযোগী কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিশু মনোবিজ্ঞানীরা। অনেক লেখক, গবেষক ও অভিভাবকের মতে, শিশুদের বইয়ে বিশেষ করে বানান ভুল বড় অপরাধ। তবে রঙচঙে বইয়ের আড়ালে ভুলে ভরা বই পড়ে শিশুরা কী শিখবে তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক। তাঁদের মতে, ‘আজকাল এমনিতেই পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে। আনন্দবিনোদনের নানা মাধ্যম থাকায় সৃজনশীল সাহিত্যের শিশুতোষ শাখাটিতে তেমন মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। অভিভাবকরাও সতর্ক ননশিশুদের বইয়ের রচনাশৈলী নিয়ে মনোযোগী নয় কেউ। বাণিজ্যিক চাহিদা তুঙ্গে থাকায় যাচ্ছেতাই বইগুলো বইমেলায় আসছে। ছড়া, গল্প, কবিতার বইগুলোরও একই দশা।’

আমাদের কিছু প্রকাশক আছেন, যাঁরা শিশুদের বইয়ের চাহিদার কথা চিন্তা করে মনোলোভা বই প্রকাশে তৎপর হন। শিশুদের হাতে বাবামায়েরা এসব বই তুলে দিচ্ছেন। বইগুলো বাহারি রঙে সাজানো বলেই অভিভাবকদের কাছে মনোলোভা হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু ভেতরের বিষয়বস্তু দেখে অবশ্যই হতাশ হতে হয় পাঠককে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হয়তো এসেছে নতুন ফ্যাশন, এসেছে নতুন আঙ্গিক, এসেছে নতুন চিন্তাধারা। কিন্তু পাঠকের পাঠাভ্যাস যে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে, তা বোঝা বড় দায়।

বইয়ের মানোন্নয়নে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্নতমানের প্রকাশনার দিকে জোর দিয়ে থাকি। প্রকৃতপক্ষে লেখার গুণগত মানের দিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত। আমাদের দেশে প্রচুর লেখক। যে কেউ ইচ্ছে করলে লেখালেখি করতে পারেন। লিখতে লিখতেই তাঁরা পোক্ত হবেন ধীরে ধীরে। ক্রমশ তাঁরা বুঝবেন যে লেখার জন্যও একজন লেখকের প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার জানাশোনা প্রয়োজন। মানসগঠন প্রয়োজন। এজন্য লেখালেখিতে ‘আবর্জনা’ থাকবেই। সেই ‘আবর্জনা’ থেকে যেনো একটি ভালো মানের বই পাঠক পেতে পারেন, তারজন্য প্রকাশকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আমাদের ভুললে চলবে না যে শিশুসাহিত্য হচ্ছে জাতিগঠনের ভিত। সারা পৃথিবীর সকল চিন্তাবিদ অনুভব করেছেন জাতিগঠনে শিশুসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু শিশুসাহিত্যের প্রকাশনায় লেখকপ্রকাশকের যতখানি মনোযোগ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা আরো বৃদ্ধি করা দরকার।

তবে আনন্দের সঙ্গে বলা যায়, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে প্রায় সর্বপ্রান্তস্পর্শী। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসব ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের শিশুসাহিত্যিকদের ইতিহাসসচেতন করে তুলেছে। সেই সাথে তাঁদের রচনায় যুক্ত হয়েছে সমকালীন বিষয়প্রসঙ্গ।

বরাবরের মতো এবারের বইমেলাতেও ছোটোদের জন্য প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার হাতে এসেছে এমন বইয়ের মধ্যে রয়েছে এলিজাবেথ আরিফা মুবাশ্‌শিরার ‘ফুলের রঙে আঁকা’, দীপক বড়ুয়ার ‘যুদ্ধজয়ের গান’, সৈয়দ জিয়াউদ্দীনের ‘বর্ণমালার বর্ণমেলা’, অমিত বড়ুয়ার ‘নির্বাচিত কিশোরকবিতা’, আকাশ আহমেদের ‘মেঘ বলেছে বৃষ্টি হবে’, মারজিয়া খানম সিদ্দিকার ‘মোরগ ডাকা ভোর’, কাসেম আলী রানার ‘কালো পুতুল’, জায়তুননেসা জেবুর ‘আয়রে সোনা লক্ষ্মী সোনা’, মির্জা মোহাম্মদ আলীর ‘ছড়ায় ছড়ায় মন’, কানিজ ফাতিমার ‘চাঁদ নেমেছে পুকুর জলে’, রুনা তাসমিনার ‘সোনালি পরি ও সবুজ ডানার হাঁস’, লিপি বড়ুয়ার ‘ভুতুড়ে বাড়ি’, কুতুবউদ্দীন বখতেয়ারের ‘মিষ্টি ছড়া আমার পড়া’, সুবর্ণা দাশ মুনমুনের ‘মেঘভেজা দিন একলা বাড়ি’, নাটু বিকাশ বড়ুয়ার ‘একলা দুপুর’, শিরিন আফরোজের ‘আকাশ জুড়ে সূর্য হাসে’, রায়হানা হাসিবের ‘সূর্যোদয়ের গান’, বিকাশ বড়ুয়ার ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা’, শাম্‌স চৌধুরী রুশো সম্পাদিত ‘ছড়াটে’ প্রভৃতি। এরকম আরো অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে, যার অনেকগুলোর মধ্যে আমাদের প্রকৃতি ও ইতিহাস চেতনা বিদ্যমান। বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের সঙ্গে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংযোগ ঘটানোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অগ্রগতি। এটি আমাদের শিশুসাহিত্যকে দিতে পারে বাড়তি ব্যঞ্জনা। আজ যখন প্রযুক্তির বিস্ফোরণে শিশুকিশোরের অনেকেই পাঠবিমুখ হয়ে পড়ছে তখন তাদের হাতে শিশুসাহিত্যের মানসম্পন্ন বই তুলে দেওয়াই হবে আমাদের কর্তব্য।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো

(নম্বর৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণের আবরণে স্থপতি মীর মোবাশ্বের আলী
পরবর্তী নিবন্ধঅন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসিকতার প্রতীক আবরার ফাহাদ : আসিফ