নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ–বঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়ে মানুষ বিভিন্নভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে বৈষম্য, অন্যায়, দুর্নীতি ও অসাম্যের দুর্বীনিত থাবায়। অনিয়ম ও অনৈতিকতার বিষ বাষ্পে কলুষিত ‘শিশুশ্রম’ সমাজের সর্বস্তরে এমনকি রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পরিবেশে এক ভীষণ বিষফোঁড়া হয়ে বিরাজ করছে। শিশু শ্রমের জঠিল ব্যাপকতা শিশুদের প্রতি আমাদের স্নেহ, ভালোবাসাকে ম্লান করে দিয়েছে। অঞ্চল, কৃষ্টি, সংস্থা ও সরকার ভেদে শিশুশ্রম ভিন্নতর রূপে সম্ভাষিত হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের প্রেক্ষাপট বিচারে শৈশব কালকে জীবনের মুক্ত স্তর হিসেবে চিত্রিত করে। শিশুশ্রমকে নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব সংজ্ঞা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আই এল ও) সর্বনিম্ন বয়সের নিয়ম ১৩৮ ধারা মতে ১২ বছরের শিশু ঝুঁকি বিহীন হালকা কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুমতি প্রাপ্ত হয় এবং ১৫ বছরের একজন শিশু কর্মক্ষেত্রে যোগদানের অনুমতি প্রাপ্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা শিশুশ্রমকে এ মর্মে সংজ্ঞায়িত করে যে, বয়স এবং কাজের ধরন অনুযায়ী সে কাজ যেন ন্যূনতম ঘণ্টা সীমারেখা অতিক্রম না করে। শিশু শ্রমের কার্য সংক্রান্ত বিষয়ে আই এল ও’ এর তিনটি শ্রেণি বিভাগ আছে, যেমন অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম শিশু, শিশুশ্রম এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। শিশুদের অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয় যেখানে শিশুর কাজগুলো স্কুল কিংবা ঘরের বাইরে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ করাকে বুঝায়। শিশুদেরকে শিশু শ্রমের আওতায় আনা হয় যখন ১২ বছরের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আসে যখন শিশুদের এমন কাজে যুক্ত করা হয় যখন তাদের শ্রম শারীরিক, মানসিক এবং স্বাস্থ্য বৃদ্ধি ও নিরাপত্তার বিষয়ে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শিশু বিষয়ক জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশু শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করে ‘এটি এমন এক কাজ যা শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ব্যাহত করে‘। সংস্থাটি এও বর্ণনা করে যে ‘শিশুশ্রম একটি কাজ যা শিশুদেরকে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চনা, অপব্যবহার ও শোষণের দিকে ধাবিত করে’। শিশুশ্রম নির্মূল আন্তর্জাতিক কর্মসূচি (আই পি ই সি) শিশুশ্রমে সম্পৃক্ত অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম শিশুদেরকে গ্রামীণ অথবা শহুরে এলাকায় আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বেতন বা অবৈতনিক কাজে সম্পৃক্ত রাখাকে বোঝায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী বেতন বা অবৈতনিকভাবে সপ্তাহে ১ বা অধিক ঘণ্টা কাজে নিয়োজিত শিশুদেরকে শিশু শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত ১০ বছরের অধিক বয়সী শিশুদের কাজকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করে।
ইউ এস ডিপার্টমেন্ট অব লেবার ব্যুরো অব ইন্টারন্যাশনাল লেবার আফেয়ার্স কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় শিশুশ্রম বা জোরপূর্বক শ্রম দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের তালিকা অনুযায়ী ৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামোল্লেখ করা আছে যেখানে শিশুশ্রম বা জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ শিশু শ্রমিক কৃষি কাজে নিযুক্ত থাকে। হাঁস মুরগী পালন, লবণ উত্তোলন, চিংড়ি চাষ, রসদ উৎপাদন, ইটভাঙা, ইট ভাটার কাজ ইত্যাদি শিশু শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র। কৃষিতে শিশুরা ভারী বোঝা বহন করে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। যার ফলে শিশুদের মাঝে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্র যে গুলোতে শিশুরা নিয়োজিত থাকে তা হচ্ছে জাহাজ ভাঙা, পুনঃব্যবহার কার্যক্রম, সাবান, ম্যাচ, ইটভাঙা, সিগারেট, পাদুকা, আসবাবপত্র, কাচ, পাট, চামড়া, বস্ত্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। আনুষ্ঠানিক খাতে পোশাক শিল্প শিশু শ্রমের বড় নিয়োগকারী। পোশাক শিল্প শুধু অর্থনৈতিক উপার্জনই বাড়ায়নি বরং শহুরে পরিবেশে বিশেষ করে মহিলাদের জন্য সহজলভ্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলে শহরাঞ্চলে শিশু শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে যোগদান উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়। শিশুরা বিশেষ করে মেয়েরা শহরাঞ্চলে ব্যক্তিগত পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে যেখানে তারা অমানবিক হয়রানি, মানসিক ও শারীরিক এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা জীবন–জীবিকা রক্ষার প্রয়োজনে ব্যক্তিগত বাড়িতে কাজ করা শিশুরা প্রায়শই অপব্যবহার ও শোষণের শিকারে পরিণত হয়। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি অনেক সময় জল্লাদ গৃহকর্ত্রীরা এসব নিষ্পাপ গৃহকর্মীদের শরীরে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে থাকে। কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা মানসিক, শারীরিক চাপ ও স্বাস্থ্য সমস্যার শিকারে পরিণত হয়েও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
দারিদ্রতা ব্যাপকভাবে শিশু শ্রমের প্রাথমিক কারণ হিসেবে স্বীকৃত। দারিদ্রতা ও শিশু শ্রমের যোগ সাদৃশ্যকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং জাতিসংঘের সমঝোতায় দারিদ্র বিমোচন নীতিমালার নিরিখে শিশুশ্রম হ্রাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। একটি দেশের আয়ের স্তর এবং শিশুশ্রম সংঘটন হারের মধ্যে জোরালো পারস্পরিক নেতিবাচক সম্পর্ক বিরাজমান। ০–৫০০ ডলার মাথাপিছু আয়কে ৫০০–১০০০ ডলার মাথাপিছু আয়ে বর্ধিত করা গেলে ৩৪%- ৬০% শিশু সংঘটন হারকে ১০%-৩০% হারে নামিয়ে আনা যাবে। যদিও বাংলাদেশে ৫–১৩ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে গঠিত পরিসংখ্যান মতে মূল শ্রমশক্তির মধ্যে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৯%-১৩ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। আবার ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফ পরিচালিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৩.৩ শতাংশ সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে।
জীবন যাত্রার মান ধরে রাখার প্রয়াসে পরিবার প্রায়শই শিশুদের অতিরিক্ত আয়ের উপর নির্ভরশীল। পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে অনেক শিশু কাজ করতে বাধ্য হয়। অন্যথায় পরিবার পরিত্যক্ত কিংবা পরিবারের অসচ্ছল অবস্থার কারণে অনেক শিশু নিজের জীবন রক্ষার্থে শিশুশ্রমে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় পারিবারিক আয়ে অবদান রাখার লক্ষ্যে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারের শিশু সন্তানরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রম শক্তিতেই সম্পৃক্ত হয়। চিরায়ত বাংলায় ঐতিহ্যগত কৃষি কাজের ধারায় প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে স্বাভাবিকভাবে শিশুরাও মাঠের কাজে নিয়োজিত থাকে। ১১–১৪ বছরের বালিকাদের চেয়ে অধিক হারে বালকদেরকে গ্রামীণ বা শহুরে পরিবেশে শিশু শ্রমে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। শিক্ষার অভাব শিশু শ্রমের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে চলেছে। শিশুশ্রম স্কুলগামী অভ্যাসে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে শিশুদের শিক্ষায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে অনেক নীতিমালার উপর জোর দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জাতিসংঘ এবং ইউনিসেফ ‘এর মতো সংস্থাসমূহ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনিসেফ এর পরামর্শ মতে নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োজনে শিশুদেরকে অবশ্যই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে যেখানে পড়ালেখা হবে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে। শিশুশ্রম ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির মধ্যে একটি লক্ষ্যণীয় সম্পর্ক বিরাজ করে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রায় ৫৮% কর্মজীবী শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কারণ হিসেবে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অবশ্য নিরক্ষরতার হার অনেকাংশেই শিশুশ্রম ব্যাপকতার পূর্বাভাস। শিশু আইনের ধারা–৪ এ বলা আছে আপাতত বলবৎ থাকা অন্য কোন আইনে কিছু দিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ১৮ বছরের কম বয়সীরা শিশু হিসেবেই গণ্য হবে। বাংলাদেশের আইনে উল্লেখ আছে, কম বয়সী শিশুদেরকে শিশুশ্রম বা জোর পূর্বক শিশুশ্রমে সম্পৃক্ত করা যাবে না। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। ইউনিসেফ ‘এর হিসাব মতে আমাদের দেশে ৫–১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৪৭ লাখ। এদের মধ্যে ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিশু শ্রমের পক্ষে বিপক্ষে অনেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক কথা বলে থাকেন এমন অনেকের ধারণা এইসব শিশু শ্রমিকদের আয় পিতা মাতার সংসারে প্রভূত অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারে সর্ব মহলের প্রচলিত আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করে শিশুদের জন্য লেখা পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। শিশু শ্রমিকদের জীবনের গল্প অকল্পনীয় ও হৃদয় বিদারক। জীবন বিধ্বংসী শিশুশ্রম যে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বৃদ্ধির পথে অন্তরায় সে বিষয়ে পিতা–মাতাকে যথার্থভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা লাভের সুযোগ সুনিশ্চিত করতে হবে। শিশুশ্রমে উৎসাহ প্রদানকারী ব্যক্তিদেরকে নিরুৎসাহিত করে শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণে যুগপৎভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক মানসিক বিকাশ এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত প্রয়াস তাদের আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সফল শ্রম শক্তিতে রূপান্তরিত হতে যথেষ্ট অবদান রাখবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ।