শিশুশ্রম ও শিশুশিক্ষা : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

কামরুন ঋজু | রবিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

শিশুশ্রম শিশুদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। যখন একটি শিশু শ্রমে নিয়োজিত থাকে তখন তার পক্ষে স্কুলে যাওয়া এবং ভালোভাবে পড়াশোনা করা সম্ভব হয় না।

শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে প্রতি বছর পালিত হয় বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সত্যিকার অর্থে এই দিবস কাগজে কলমেই উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে অগণিত শিশু জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এসব কাজে নিয়োজিত শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জাতিসংঘ শিশুঅধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের এ সনদ অনুমোদন করেছে। অপরিণত বয়সে শারীরিক ও মানসিক যে কোন ধরনের পরিশ্রমকে শিশুশ্রম বলা হয়।

শিশুশ্রম ও শিশু শিক্ষা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং একে অপরের জন্য ক্ষতিকর। শিশুশ্রম শিশুদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, যা তাদের ভবিষ্যৎ বিকাশে বাধা দেয়।

শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের সচেতন ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের। উন্নত দেশে শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সেভাবেই তাদের পরিচর্যা করা হয়। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেও এখানে দরিদ্রের হার বেশি। এখানে শিশুরা সেরকম কোন পরিচর্যা পায় না। দরিদ্র পরিবারে অর্থের অভাব প্রকট। অভাবের কারণে বাবামা সন্তানদের স্কুলে দিতে পারে না। তাই অল্প বয়সে শিশুদের কাজের জন্য দিয়ে দেয়। অভাবের তাড়নায় বাবামা শিশুদের কাজে পাঠিয়ে সাময়িক সুফল ভোগ করলেও এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। শিশুশ্রম একটি অমানবিক সামাজিক সমস্যা। এটি দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক অভিশাপ। অপরিণত বয়সে শিশুরা অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে অপুষ্টিজনিত নানা রোগে ভোগে স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের রোগের পরিমাণ বাড়তে থাকে। তারা আর কখনো সুস্বাস্থ্য ফিরে পায় না। ফলে তারা দেশ ও জাতির কোন উপকারে আসে না। তাই দেশ ও জাতির উন্নতির কথা ভেবে শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি কর্তব্য।

যে শিশুটি ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুলে যায়, সে যত ভালো স্কুলে যাক না কেন তার শেখার মান ও ধারণ ক্ষমতা অনেক কম হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ৪৬ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। তীব্রতম অপুষ্টির শিকার দেশের অনেক শিশু। যে হাতে পড়ার বই থাকার কথা, সেই হাতেই জীবনের তাগিদে কাজের সরঞ্জাম তুলে নেয় কোমলমতি শিশুরা। শিশুশ্রমিকরা কাজে নিয়োজিত থাকে বলে স্কুলে যেতে পারে না। ফলে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। অভাব ও ক্ষুধার জ্বালা বাধ্য করেছে শিক্ষার পথ ত্যাগ করে শ্রমের পথ বেছে নিতে।

করোনা মহামারির সময় অনেক শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে ছিল, তীব্র আর্থিক সংকটের কারণে তারা করোনাপরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর ফিরে আসে নি। ওই সময় অনাথ শিশুর সংখ্যাও বেড়েছে। এসব অনাথ, অভিভাবকহীন শিশুদের অনেকেই কাজ করতে গিয়ে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মেয়ে শিশুরা আরো বেশি ঝুঁকিতে। কাজ করতে গিয়ে অনেকে ধূমপান, মাদক ও বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। আমাদের সবার কর্তব্য এইসব শিশুশ্রমিকের পাশে দাঁড়ানো। অসহায় নিষ্পাপ শিশুদের পূর্ণ অধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির উন্নতির কাজে এগিয়ে আসবে এসব শিশুরা। দেশবিদেশের বিভিন্ন সংস্থা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও এখনো বিশ্বে বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম। বাংলাদেশেও শিশুশ্রমের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখানে শতকরা ৫৬ ভাগ শিশুশ্রমিক খোলা আকাশের নিচে ভাসমান জীবনযাপন করে। আর ৪৪ ভাগ শিশুশ্রমিক কোনরকমে গৃহে বাস করে। কেউ কেউ ঠিকমতো দুবেলা পেটপুরে খেতেও পারে না। সারাদিন কাজ করেও শ্রমের সঠিক মূল্য পায় না। কাজের মাঝে কোনো বিরতি নেই। কোনো বিনোদনের ব্যবস্থাও নেই। অনেক সময় নোংরা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শিশুদের কাজ করতে হয়। কম মজুরি দিয়ে অসহায় শিশুদের কাছ থেকে বেশি সময় আদায় করে নেয় স্বার্থপর মালিকশ্রেণি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দুরবস্থা হচ্ছে শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ। সংসারে অভাব অনটনের কারণে লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পেরে মাবাবা সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের সুপ্ত প্রতিভা অংকুরেই বিনষ্ট হয়। ছোট ছোট কলকারখানা থেকে শুরু করে ইট ভাঙা, ফেরি করা, ভিক্ষাবৃত্তি করা, বাসাবাড়িতে কাজ করা, গার্মেন্টস, গ্যারেজ, হোটেল, দোকানপাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ, শিশুদের দিয়ে তা করানো হচ্ছে। বয়সের চেয়ে কাজের ভার বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ শিশুর জীবন কর্মক্ষেত্রে অনিরাপদ হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম বন্ধের একমাত্র উপায় হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসন। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে শিশুদের জন্য নিরাপদ কর্মঘণ্টা ও কর্মপরিবেশ। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির প্রসার সহ সারাদেশে দরিদ্র শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বিদেশি এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর ফলপ্রসু উদ্যোগের মাধ্যমেও শিশুশ্রমের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে সরকারের দিক থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ সহ প্রয়োজন বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা। এ ব্যাপারে সরকার আইন প্রণয়ন করলেও শুধু আইনের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে না। সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত অংশগ্রহণই পারবে বাংলাদেশকে শিশুশ্রম মুক্ত দেশে পরিণত করতে। আর শিশুরা শ্রমমুক্ত হলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজ ও দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

প্রতিটি শিশুরই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। সরকার ও সমাজের সকলের উচিত শিশুদের এই অধিকার নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়া।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধসৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় লোহাগাড়ার যুবকের মৃত্যু