শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে

| শুক্রবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতা বলতে কী বুঝি? বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবার, সমাজ, প্রকৃতি থেকে শিশু যে বিষয়ে আগ্রহী হয় ও ধারণা সংগ্রহ করে এবং তা নিজের অনুভূতি থেকে চিত্র, গান-কবিতা, মাটির কাজ, রঙের ব্যবহারের মাধ্যমে বা তার দ্বারা সম্ভব সব বস্তু থেকে যে সৃষ্টি আমাদের উপহার দেয়, তাকেই শিশুর সৃজনশীলতা বলে।
মেধা ও সৃজনশীলতা এক নয়, অনেক মেধাবী মানুষ আছে যারা শিক্ষা জীবনে ভীষণভাবে সফল, কিন্তু ব্যক্তি এবং কর্মজীবনে সেইভাবে নয়। অনুরূপভাবে সৃজনশীল মানুষ তা ব্যক্তি ও কর্মজীবনে অনেক বেশি সফল। তাই সৃষ্টিশীল প্রতিটি মানুষ মেধাবী, তারা তাদের মেধার বহুমাত্রিক প্রয়োগের মাধ্যমে যেমনি আত্মতৃপ্ত হয় সেভাবেই মেধার বিকাশ ঘটায়। তাই বলা যায় মেধা বিকাশের স্বার্থে সৃজনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।
শিশু-কিশোরদের সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা কোথায়! আমাদের অভিভাবকদের বেশিরভাগ পাঠ্যপুস্তকের পড়ার ওপর জোর দিয়ে থাকেন। শিশুরা নিজ থেকে কিছু করতে চাইলে সেটা অনেক সময় করতে দেয়া হয় না। তারা মনে করেন সেটা পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা, গণিত ও ইংরেজির সাথে চারুকারু ও সঙ্গীত শিক্ষাও যে প্রয়োজন, তা বুঝতে চান না। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষক ও অভিভাবক উক্ত বিষয়গুলোর প্রতি উদাসীন বা গুরুত্ব কম দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক হাওয়ার্ড গার্ডনার তার ‘ফ্রেমস অব মাইন্ড : দ্য থিওরি অব মাল্টিপল ইন্টিলিজেন্সেস’ -এ শিখনের ৮ ধরনের বুদ্ধিমত্তার কথা উল্লেখ করেছেন। তারমধ্যে শিশুর সৃজনশীল বিকাশের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কোন কোন শিশু শোনা, বলা, নঙা, ছবি, রেখাচিত্র, রূপকল্পনার সাহায্যে শেখে। কেউ আবার শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে হাতে কলমে কাজ করে শেখে। সঙ্গীত, ছড়া, গল্প, সঙ্গীতের তাল ও লয়ের মাধ্যমে সহজে শিখতে পারে। কোন কোন শিশু আবার প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সহজেই শিখতে পারে। এ শিক্ষা সবই শিশুর সৃজনশীল বিকাশকে গতিশীল করে থাকে। শিশুদের বয়স ও সামর্থ অনুযায়ী খেলারছলে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
শিশু শিক্ষক ও অভিভাবকের কাছ থেকে উৎসাহ ও স্বীকৃতি পেলে সে সেই কাজে আরো বেশি আগ্রহী ও মনোযোগী হবে। পরবর্তীতে সে আরো ভালো কিছু করার উৎসাহ পাবে। সমাজে সাধারণ শিশুদের সাথে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সৃজনশীল বিকাশে সহযোগিতা করলে তারা পরিবারের ও সমাজের বোঝা না হয়ে জনসম্পদে পরিণত হবে। শিশুর সৃজনশীল বিকাশই পারে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ উপহার দিতে। তাই শিশুর সৃজনশীল বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের সাথে শিক্ষকেরও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ।
এখানে বলে রাখা দরকার যে, বাঙালি শিশুর জন্য শিশুপাঠ কেমন হওয়া উচিত-সেই পথ প্রথম দেখালেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ১৮৪৯ সালে ‘শিশু শিক্ষা’ গ্রন্থমালা লিখে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’ এই লাইনটি ‘শিশু শিক্ষা’ প্রথম ভাগের ‘প্রভাতবর্ণন নামে চিরকালের শিশু কবিতার অংশ। ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়িঘোড়া চড়ে সে’-একসময়ে ছোটোদের কাছে এই আপ্তবাক্যটি আওড়ানো হতো। সময়ের পরিবর্তনে আজ এই বাক্যটি ভুলে যেতে বসলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটি ছিলো বিদ্যা গ্রহণ বিষয়ে উজ্জীবনের মূলমন্ত্র। এই বইয়ে প্রচুর নীতিশিক্ষা রয়েছে। তবে কোনো বিশেষ ধর্মীয় নীতিবোধের চেয়ে সর্বজনীন মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশুসাহিত্য সে হিসেবে আনন্দ আর শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয়। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘শিশু শিক্ষার পুস্তকে যে বস্তু বাদ পড়ে যায়- অর্থাৎ আনন্দ-সেই বস্তু যুগিয়ে দেবার উদ্দেশ্যেই এ সাহিত্যের সৃষ্টি’। বিষয়টাকে আরো খোলাসা করেছেন নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ‘শিশুসাহিত্য আনন্দের আশ্রয়ে চরিত্রগঠন ও শুভবুদ্ধির সঞ্চার মাতৃস্নেহ, পিতৃনিয়ন্ত্রণ এবং খেলার সাথীর সাহচর্য-এই তিনটির উপরেই নির্ভর করে’। শিশুসাহিত্য গবেষকদের নানা মতকে আমরা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে এই ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে শিশুসাহিত্য হলো ছোটোদের এক রঙিন জগৎ। তাদের মনে বিশুদ্ধ আনন্দরস সঞ্চারের জন্য যে সাহিত্য রচনা করা হয়। যে রচনা পড়ে ছোটোরা মজা পায়, আনন্দ পায়, পরিতৃপ্ত হয়। তাকে তারা সহজেই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে নেয়। ছো্‌টোদের চঞ্চল, কল্পনাপ্রবণ ও জিজ্ঞাসু মনকে অনুষঙ্গ করে সাহিত্য রচনা করেন লেখকরা। হাসি, কৌতুক, মজা বা আনন্দ গ্রহণের অন্তরালে ছোটোরা অনায়াসে পেয়ে যায় জাগতিক জ্ঞান, বুদ্ধি-যুক্তি ও চিন্তার চমৎকার উপাদান। এই জ্ঞান বা শিক্ষা জটিল নয়, কঠিন নয়, জগৎ ও পরিবেশ বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান। সাহিত্যিকদের এসব রচনা থেকে জীবনকে দেখবে এবং অনিসন্ধিৎসু মন দিয়ে খুঁজে পাবে জীবনের বিচিত্র রূপ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে