শিল্পী মন কখনো তুষ্ট নয়। সাহিত্যে সন্তুষ্টি নেই। যিনি যত ভালোই লিখেন, তাঁকে আরো ভালো লেখার জন্য তৈরি থাকতে হয়। শিল্পীরা হলেন সমস্ত শিল্পের স্রষ্টা। মনের চেতনায় তিনি সৃষ্টি করেন শিল্পবোধ, অন্তরকে জাগ্রত করেন, ঋদ্ধ করেন পাঠককে। আমরা যারা শিল্পের আরাধনায় আছি, সাধনায় আছি, আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে নিজের কাজের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করা। এ বি এম সালেহ উদ্দীন লেখেন, ‘শিল্পী তার শিল্পের মাধ্যমে অন্যের হৃদয়কে নাড়া দেন। অন্যের হৃদয়কে স্পর্শ করার চেষ্টা করেন। শিল্পী চান মানুষের ভেতরের মানুষকে আবিষ্কার করতে। আসলে একজন শিল্পীর সুখ, আনন্দ তৃপ্তির বৈচিত্র্য সম্ভারের মাধ্যমে পৃথিবী, প্রকৃতির সুন্দরতম দিকগুলো ফুটে ওঠে। তেমনই মানুষের সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনার ভেতরে স্থায়ী আসন গেড়ে নিতে পারলেই একজন শিল্পীর পূর্ণতা আসে, মানবভুবন নির্মল ও শান্তিময় হয়ে ওঠে। মানুষের অন্তরে প্রেম ও ভালোবাসার সৌন্দর্য ভরে ওঠে কানায় কানায়। সমাজ ও দেশ সচকিত সৌকর্যময় হয়ে ওঠে। শিল্পী মানসে সৃজনের যে শক্তি আছে, এর মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধনই তার প্রধান লক্ষ্য।’
শিল্পের ভুবন তৈরিতে সন্তুষ্টি না থাকলেও আমরা অভিভূত হয়েছি সম্প্রতি শেষ হওয়া শিশুসাহিত্য উৎসবে সাহিত্যপ্রেমীর ব্যাপক উপস্থিতি দেখে। এখানে বিরাট সন্তুষ্টি কাজ করছে আমাদের মনে। ২৫ ও ২৬ অক্টোবর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই উৎসব উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। যিনি এ অঞ্চলে শিল্পসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সকলের কাছে সমান সমাদৃত। আমাদের অধিকাংশ শিশুসাহিত্যিক দৈনিক আজাদীর ‘আগামীদের আসরে’ লেখালেখি করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এই আসরে লিখে লিখে অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক আজাদী প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ফিচার পাতা চালু করেন ‘আগামীদের আসর’। কারণ তিনি মনে করতেন শিশুদের যদি আমরা ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারি, তাদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে যদি সহায়তা না দিই, তাহলে জাতি সমৃদ্ধ হবে না। কেননা, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামীর দেশ গড়ার কারিগর, কর্ণধার। আজ ৬৫ বছর ধরে দৈনিক আজাদী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সেই আদর্শটা ধরে রেখেছে। এই পাতায় শিশুরা লিখছে, আবার শিশুদের লেখকরা লিখছেন। এভাবেই এ অঞ্চলে বিকশিত হচ্ছে আমাদের শিশুসাহিত্য।
শিশুসাহিত্যের প্রথম শর্ত হলো ‘শিশুকে ভালোবাসা’। আমরা জানি, ১৮৪৯ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ‘শিশু শিক্ষা’ গ্রন্থমালা লিখে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। ‘পাখি সব করে রব–রাতি পোহাইল’ এই লাইনটি ‘শিশু শিক্ষা’ প্রথম ভাগের চিরকালের শিশু–কবিতার অংশ। ‘লেখাপড়া করে যে– গাড়িঘোড়া চড়ে সে’–একসময়ে ছোটোদের কাছে এই আপ্তবাক্যটি আওড়ানো হতো। সময়ের পরিবর্তনে আজ এই বাক্যটি ভুলে যেতে বসলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটি ছিলো বিদ্যা গ্রহণ বিষয়ে উজ্জীবনের মূলমন্ত্র। এই বইয়ে এরকম প্রচুর নীতিশিক্ষা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শিশু ও কিশোর মনের জগৎ আলাদা। তাদের জন্য লেখা সাহিত্যের জগৎও স্বতন্ত্র। অধিকাংশ সাহিত্যিক এই স্বাতন্ত্র্য মেনেই সচেতনভাবে শিশুসাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন। উৎসবের উদ্বোধক এম এ মালেক বলেছেন, যে সমস্ত লেখা পড়ে শিশু ও কিশোররা আনন্দ পায়, জাগতিক শিক্ষা পায় এবং মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করে, সে–ধরনের লেখা উপহার দিতে হবে লেখকদের। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর মনের রাজ্যে প্রবেশ করে কল্পনার আলো। তখন সে যেদিকে তাকায়, সব দিকে পায় আনন্দ। শিশুর এই আনন্দকে ধারণ করে শিশুর জন্য ভালো বই রচনা করা ও প্রকাশ জরুরি।
উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা। তিনি শিশুদের বইমুখী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যিনি যাই বলুন, সাহিত্যচর্চা যে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, লোকে যে তা সন্দেহ করে তার কারণ এই শিক্ষার ফল হাতেহাতে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ তার কোনো নগদ বাজারদর নেই। এই কারণে ডেমোক্রেসি সাহিত্যের সার্থকতা বোঝে না, বোঝে শুধু অর্থের সার্থকতা। ডেমোক্রেসির গুরুরা চেয়েছিলেন সকলকে সমান করতে, কিন্তু তাদের শিষ্যরা তাদেরকে উল্টো বুঝে সকলেই হতে চায় বড় মানুষ। একটি বিশিষ্ট অভিজাত সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েও ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে আমরা গুণগুলো আয়ত্ত করতে না পেরে তার দোষগুলো আত্মসাৎ করেছি। এর কারণও স্পষ্ট, ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়।’ লেখক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা সাহিত্যের সার্থকতার জন্য বেশি বেশি পাঠ গ্রহণের দিকে গুরুত্ব দেন।
শিশুসাহিত্য উৎসবের সমাপনী দিনে ছিল শিশুসাহিত্য সম্মাননা প্রদান, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম। এ বছর বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি সম্মাননা পেলেন বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক মাহমুদউল্লাহ, শিশুসাহিত্যিক আহমেদ জসিম, গল্পকার ইফতেখার মারুফ। এতে আলোচক ছিলেন খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার, শিশুসাহিত্যিক অরুণ শীল, শিশুসাহিত্যিক রমজান মাহমুদ। এর আগে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর রীতা দত্ত। বক্তারা বলেন, শিশুসাহিত্যিকরা শিশুর মনোজগতকে সমৃদ্ধ করে। তারা শিশুদের পরম বন্ধু হিসেবে শিশুসাহিত্য রচনায় সচেষ্ট থাকেন। তাঁরা বলেন, সারাদেশের সাহিত্যকর্মীরা নানা প্রতিকূলতার কথা ভেবে যেখানে তটস্থ সেখানে চট্টগ্রামে এই সুন্দর আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়। ড. আনোয়ারা আলম সুস্থ ও রুচিশীল সমাজ বিনির্মাণে লেখক সমাজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে দেন তাঁর বক্তব্যে। আগামী প্রজন্মের জন্য প্রদান করেন সুন্দর দিকনির্দেশনা।
আমরা দেখেছি এই উৎসবে চট্টগ্রামে অবস্থানরত প্রত্যেক শিশুসাহিত্যিক সনিষ্ঠ আন্তরিকতায় অংশগ্রহণ করেছেন। সমস্ত বিবাদ ও বিভেদ ভুলে এক ছাতার নিচে জড়ো হয়ে জানান দিয়েছেন আমরা আছি একসাথে, কাজ করছি একসাথে– সৌরভে গৌরবে। দলমত নির্বিশেষে সকল শিশুসাহিত্যিক তাঁদের লেখা পাঠ করেছেন, আলোচনায় অংশ নিয়েছেন এবং আগামীতেও একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
একটা বিষয় আমাদের ভুললে চলবে না, শিশুসাহিত্য রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছেন, তাঁদের আরো উদার হতে হবে। পাঠকের মতামত ধারণ করতে হবে। হতে হবে ভদ্র ও রুচিশীল। তারজন্য লেখকের মানসগঠন জরুরি। সুখলতা রাও ‘শিশুসাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও রুচি’ বিষয়ে লিখেছেন: ‘শিশুসাহিত্যের ভিতর দিয়ে শিশুর সরল মনে যে ছবি, যে–শিক্ষা, যে–আদর্শ পৌঁছায়, তাহা তাহার অজ্ঞাতসারে সেখানে নিজের ছাপ রাখিয়া যায় এবং ভবিষ্যতে তাহার শিক্ষা দীক্ষা, এমনকি রুচির উপরে প্রভাব বিস্তার করে।’ বিষয়টিকে আরো ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন প্রাবন্ধিক অজিত দত্ত। তিনি বলেছেন, “আমাদের সকলেরই আজ একথা উপলব্ধি করা দরকার যে, শিশুর শিক্ষা ও শিশুর সাহিত্যকে অভিন্ন করে না তুলতে পারলে, শিক্ষাও হবে অসম্পূর্ণ এবং সাহিত্যও হবে পঙ্গু। …এ শিক্ষার মানে শিশু মনে যতগুলো সদ্বৃত্তি অপুষ্ট আছে, তাদের ফুটিয়ে তোলা। এই সদ্বৃত্তির মধ্যে আছে ভদ্রতা, সমবেদনা ও করুণা, আছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নির্ভীকতা ও স্বাদেশিকতা, আছে দয়া, দাক্ষিণ্য ও মমতা, আছে মানবতাবোধ, আছে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সন্ধান। তেমনি আছে রসনাভূতি কাব্যবোধ ও সাহিত্যপ্রীতি, আছে অনুসন্ধিৎসা এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও কিছুকে বিচার করবার ক্ষমতা।” কাজেই হিংসুটে মন নিয়ে আর যা’ই হোক, শিশুসাহিত্য রচনা করা চলে না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর :৪২২), বাংলা একাডেমি।