৫৬ হাজার বর্গমাইলের বিস্তৃত বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের বসবাস এই বাংলাদেশে। এক সময় গ্রাম প্রধান থাকলেও বর্তমানে শহরকেন্দ্রিক জীবনে সকলেই অভ্যস্ত। দিন দিন শহরগুলোতে ক্রমান্বয়ে মানুষের চাপ বাড়ছে। আবাসন সমস্যার সমাধানে দিন দিন খালি জায়গাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, আমি যখন কলেজে যোগদান করি ১৯৯৯ সালের কথা। তখন কলেজের চারিপাশে অনেক খালি জায়গা ছিল। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করত। ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে কলেজের চারিপাশে পরিবর্তন আসত। শীতের আগমনে অতিথি পাখিদের বিচরণ চোখে পড়ার মত ছিল।
আসা যাওয়ার পথটিও বেশ সুন্দর ছিল। প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হত। সুন্দর সুন্দর ফুল–ফল, পাখ–পাখালি চোখে পড়ত। শৈশবের সেই ছোটকালে আগ্রাবাদ সরকারি কলোনির মাঠগুলো ছিল ছেলে–মেয়েদের কোলাহলে পরিপূর্ণ। ছেলেমেয়েরা নিরাপদে খেলাধুলা করত। আমরা এই মাঠ থেকে অন্য মাঠে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে খেলতাম। বয়স্করা মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদের খেলাগুলো উপভোগ করত। ছোট ছোট বাচ্চারাও ফাঁকে ফাঁকে খেলা করত। তখন কোন বয়সের বাধা ছিল না। সবাই এক নিয়মে খেলাধুলা করত। সেই কানামাছি, হা–ডু–ডু, দাঁড়িয়া বান্দা, মার্বেল খেলা, বল ছোড়াছুড়ি, লুকোচরি, ইত্যাদি ইত্যাদি খেলায় আমাদের শৈশবের দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। তাছাড়া বড় ভাইদের মাঝে চলতো ফুটবল খেলা ও ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতা।
আমার এখনো মনে পড়ে, মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা উপভোগ করতাম। সেই আগ্রাবাদ কলোনীর ৯নং মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একটি ফুটবল নিয়ে কী যে কাড়াকাড়ি। মাঝে মাঝে মাঠ উত্তপ্ত হয়ে যেত। তখন মনে হত–ইস, ওরা যদি সবাই একটা একটা ফুটবল নিয়ে খেলতো, আর মারামারি হত না। আমার এখনো মনে আছে মাঝে মাঝে আগ্রাবাদ ৯নং মাঠে একজন ব্যক্তি সারাক্ষণ সাইকেল চালাতো। সারা দিন রাত ধরে উনি সাইকেল চালাতেন। উনার শার্টে টাকা ঝুলানো থাকত। কলোনীর কেউ কেউ খুশী হয়ে উপহার দিত। আর আমাদের মা–খালারা সন্ধ্যার পর সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে মাঠে বসে বসে গল্প করত। এখন আর সেই নিরাপদ মাঠ নেই। আপনার আমার শিশুরা এই জাতির ভবিষ্যৎ। এই দেশের চালিকা শক্তি। একদিন ওরাই এদেশের অগতি ত্বরান্বিত করতে এগিয়ে আসবে। তাই আমাদের শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের পথকে সুগম করার দায়িত্ব আমাদের। শুধু লেখাপড়ার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষার সু–ব্যবস্থা করা যায় না। একজন শিশুকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বড় করে তুলতে হলে তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের শিশুরা যেন পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে দিকে আমাদেরও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
আনন্দময় নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশের পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলার উপযুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি যথাযথ সময়ও দরকার। শুধুমাত্র লেখাপড়া ও জীবনমুখী শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষের মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে না। এক্ষেত্রে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। এক সময় যৌথ পরিবারের সন্তানরা মা–বাব–ভাই–বোনের সাহচার্যে এসে অনেক কিছু শিখতে পারত। শিশুর স্বভাবগত অভ্যাস হচ্ছে প্রশ্ন করা। একটার পর একটা প্রশ্ন করে শিশুরা অনেক কিছু জানতে পারে। বর্তমানে শিশুদের সেই প্রশ্ন করার স্বভাবটুকু তেমন চোখে পড়ে না। শিশুদের ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর ও ইতিবাচক হয় সেজন্য আমাদেরকে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষাকে আনন্দময় করে গড়ে তুলতে আহ্বান জানান। বইয়ের বোঝা বইতে বইতে শিশু–শিক্ষার্থীরা বই বাতিকে ভুগছে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য গল্প, ছড়া, উপন্যাসের বই পড়তে কোন রকম আগ্রহ প্রকাশ করে না। পরীক্ষা ভিত্তিক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শৈশব ও কৈশোরের সুন্দর সময়গুলো হারিয়ে ফেলছে। বেশি নম্বর পাওয়ার আশায় মুখস্থ বিদ্যার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। দিন দিন পরীক্ষার চাপে সুন্দর শৈশব অতিবাহিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আনন্দদায়ক শিক্ষার জন্য নিয়মিত সাহিত্য পাঠ ও শোনা, আবৃত্তি শোনা, শেখা, ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা, সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা, নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক শিক্ষাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সুস্থ ও সুন্দর ছাত্র সমাজ তৈরীর লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকার সাংস্কৃতিক সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। প্রতি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে আমাদের সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক শ্রেণিশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে শিক্ষার মান–উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক দিকটি বিবেচনায় এনে সুস্থধারার শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫ (পাঁচ) কোটির মত। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে যন্ত্রের মত চালিত করলে মায়া–মমতাহীন, ভালোবাসাহীন ও শ্রদ্ধাহীন জাতি তৈরী হবে। বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে। উপযুক্ত খেলার ও অবসর কাঠানোর পরিবেশের অভাবে রাস্তার ধারে–ধারে কিশোররা দল বেঁধে আড্ডাবাজী করে। এই আড্ডাবাজী কখনো কখনো ঝগড়া–বিবাদে পরিণত হয়। তাই নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের কিশোররা নিজেরা দলবেধে অন্যের উপর আক্রমণ চালায়। ছোট ছোট অপরাধগুলো একসময় এক–একজন কিশোরকে বড় অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। ফলে এক–একজন সন্ত্রাসীর জন্ম হয়। শিশু বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃজনশীলতা ও আন্তরিকতাই একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক। মায়া–মমতায় ঘেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের শিক্ষা দিবে। মাঠের প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে আমার ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তার বর্ণনা দিতে হয়। বিশাল বিশাল আলিশান ফ্ল্যাটের সামনে রাস্তায় উপর ছেলেরা খেলাধুলা করে। এই ১০/১২ গজের রাস্তাটাই যেন ছেলেদের কাছে এক বিশাল ফুটবল মাঠ, ক্রিকেট মাঠ। এই জায়গাতে সারাদিনের লেখাপড়ার পরে একটি মিলন মেলার সৃষ্টি হয়। হালিশহরে বি.ডি. আর মাঠের নাম সবাই শুনেছে। এই মাঠে ছোট–বড় অনেক অনেক দলে বিভক্ত হয়ে মাঠের এক এক জায়গায় খেলা করে। এরকম শহরে হাতে গুনা কয়েকটি মাঠের এমন চিত্র আমাদেরকে হতাশ করে। পত্রিকায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, নগর পরিকল্পনাবিদ গণের মতে একটি নগরীতে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত স্থান থাকা প্রয়োজন। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের করা মহাপরিকল্পনায় শিশু– কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে মাথায় রেখে পুরো নগরীর ১০ (দশ) জায়গা উন্মুক্ত রাখার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তখন যতগুলো মাঠ ছিল, এখন তাও নেই। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য এবং আইনের বাস্তবায়নের অভাবে মাঠগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মাঠের অভাবে শিশুরা খেলতে পারে না। ফলে তারা এক প্রকার অলস সময় পাড় করে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার বিকল্প নেই। কিন্তু গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের অভাবে তারা দিন দিন আত্নবিশ্বাস হারাতে থাকে। তাদের মধ্যে যে প্রতিভা আছে সঠিক সুযোগ ও পরির্চ্চার অভাবে প্রকাশ পায় না। আমাদের বড় বড় দালান–কোটার নিচে, ছাদের উপর অথবা গ্যারেজের খালি জায়গায় আজকাল শিশুরা খেলাধুলা করে। একটা সীমাবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে থাকতে থাকতে তারা একসময় আত্নকেন্দ্রীক, অসহনীয় ও অসামাজিক হয়ে উঠে। এখানে আগুনের বিষয়টিও চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি উচ্চ ভবনের সংঘটিত আগুনের ঘটনা আমাদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ কেমন নগর পরিকল্পনা? উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চবিলাসিতায় পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রাধান্য পাচ্ছে না। খেলার মাঠ তো দূরের কথা, আগুন লাগলে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য কোন সু–ব্যবস্থা নেই। একেই বলে আমাদের যান্ত্রিক জীবন। অগ্নিদগ্ধ মানুষগুলোও এক সময় শিশু সন্তান ছিল। আমাদের শিশুরা যাতে আমাদের মতই সুন্দর শৈশব ও কৈশোরের মাঝে বড় হয় সেটাই কাম্য।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম।