৪ শিশুরা অত্যন্ত অনুকরণ প্রিয়, একথা মনে রেখে তাদের সামনে কোন কথা বলা বা যে কোনো আচার–আচরণ খুব সতর্কতার সাথে করা উচিত। শিশুর সামনে পিতা–মাতার অযথা কথা কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাটি করা উচিত নয়।
৪শিশুকে সব সময় বকাঝকা করা অনুচিত। ভালো কিছু করার উৎসাহ জোগানো, ভালো কিছু করতে পারলে বাহবা দেওয়া ও মাঝে মাঝে পুরস্কৃত করা। কখনো মিথ্যা আশ্বাস না দেওয়া। যেটুকু দেওয়া সম্ভব, শুধু তাই বলা। যা দিতে পারা যাবে না, তার কথা কখনো না বলা।
৪শিশুর সুন্দর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জন্য আদর অপরিহার্য। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন প্রশ্রয়ের পর্যায়ে না পড়ে। আদর ও প্রশ্রয়ে ভারসাম্যতার অভাব শিশুকে নষ্ট করে দিতে পারে। শিশু কোনো দুষ্টুমী করলে বা অন্যায় করলে প্রথমে তাকে বুঝিয়ে বলা। শাস্তি না। মনে রাখতে হবে শিশুকে শাস্তি দেওয়াটা হচ্ছে শাসনের শেষ অস্ত্র।
৪শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির জন্য যেমন সুষম পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন, তেমনি মানসিক বিকাশের জন্য দরকার সুন্দর পারিপার্শ্বিকতা। পিতামাতা, ভাই–বোন, আত্মীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধব বাড়ির প্রতিটি মানুষের কথাবার্তা, চালচলন, কাজকর্মের প্রভাব পড়ে শিশুর মনে। এমনকি চাকর–বাকর পর্যন্ত শিশুর জীবন ও স্বভাবকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এবং এসব কিছুর সমন্বয়ে শিশুর নিজস্ব একটি মানসিকতা গড়ে উঠে। কিন্তু একবার শিশুর কচিমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে বা বিপথে চালিত হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
৪জীবনের প্রথমাবস্থায় পিতামাতার সান্নিধ্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে শিশুর জগত। জ্ঞান হবার পর থেকে মাতা–পিতার প্রতিটি কার্যকলাপ সে আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করে। মায়ের চরিত্র ও মায়ের জীবনের প্রভাবই সবচাইতে বেশি পড়ে শিশুর জীবনে। তার মাই তার আদর্শ। মায়ের পরেই আসে বাবা। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারে যেমনটি হয়ে থাকে, পরিবারে বাবার উপস্থিতি ও প্রাধান্য একটু বড় হলেই সে বুঝতে পারে। খুব তীক্ষ্ণভাবে অনুধাবন করতে চেষ্টা করে বাবার আচরণ, চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গী, পছন্দের জিনিস। বাবা গায়ক হলে সেও হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ে। বাবাকে সিগারেট খেতে দেখলে সেও আগুন জ্বালিয়ে একটা টানতে শুরু করে।
৪শুধু তাই নয়, বাবা–মার পারস্পরিক সম্পর্কের ছবি সন্তানের মনে গাঁথা হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় স্বামীর উপর রাগ করে অনেক স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর উপর রাগ করে অনেক স্বামী সন্তানকে মারধোর করেন। এতে শিশুর মনে বাবা–মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। বাড়িতে সব সময় খিট্্মিট লেগে আছে দেখে শিশু অধিকাংশ সময় বাড়ি থেকে দূরে অন্যান্য আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু–বান্ধবদের বাসায় রাত কাটায়। কখনোবা অসামাজিক কার্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। শিশুর বয়স অল্প হতে পারে, তবু মনে রাখা চাই ২–৩ বছরের শিশুর অনুভূতি ও অত্যন্ত প্রবল, স্মরণ শক্তি খুবই প্রখর।
৪শিশু কখনো মিথ্যা বলবে না যদি এই ধারণা পোষণ করেন, তবে শিশুর সামনে কোনো মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। সন্তান যে কাজ করলে নিজে খুশি হবেন, সেই কাজ নিজে করে দেখাতে হবে। তাহলে তাকে উপদেশ দেবার প্রয়োজন হবে না, সে এমনিতেই শিখে যাবে। শিশুর সামনে কোন কিছু গোপন করার কিংবা লুকানোর চেষ্টা করা অনুচিত। এতে লুকানো জিনিসের প্রতি তার আগ্রহ অধিক বেড়ে যায।
৪শিশুরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তার সাথে হাসিমুখে কথা বললে সেও হাসি মুখে জবাব দেবে। সামান্য আদরের সাহায্যে শিশুমন জয় করা যায়। অনুরূপভাবে সামান্য আঘাত, সামান্য কটুকথা তার মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যার বিরুদ্ধে তার কচিমন বিগড়ে যায়, বহুদিন ধরে ঐ লোককে সে সন্দেহের চোখে দেখে। শিশু বয়সের বন্ধুত্ব হয় নির্ভেজাল, সেখানে থাকে না কোনো কুিটলতা বা স্বার্থ। এই জন্য বাল্যকালের বন্ধুর কথা মানুষ বড় হয়েও ভুলতে পারে না। শিশুর মন এত স্পর্শকাতর বলেই যে ছেলে–মেয়ে তার পিতা–মাতার কাছ থেকে সব সময় আদরের কথা শুনে এসেছে, কোন কারণ বশতঃ হঠাৎ যদি তাকে কটু কথা বলেন, বা ধমক দেন পিতামাতা, তাহলে সে মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। এমনকি তার বাক্্শক্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৪সব পিতামাতার নিকট তার শিশু খুবই প্রিয়। আর্থিক অবস্থা যাই হোক, সচ্ছলতা না থাকলেও অনেক পিতা–মাতা ধার কর্জ করেও শিশুর চাহিদা পূরণ করতে চান, বিশেষ করে কয়েকটি মেয়ে সন্তানের পর ঘরে একটি ছেলে সন্তানের বেলায় এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে মনে রাখা উচিত– আর্থিক ক্ষমতা যাই থাকুক, একটি সময়ে সন্তানের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না, অথবা একটা সময়ে এমন কিছু সে চেয়ে বসবে যা পূরণ করা মোটেও সম্ভব নয়। যে সবসময় সব কিছু পেয়েছে হঠাৎ করে কোন কিছু না দেয়া হলে সে মনে আকস্মিক আঘাত পেতে পারে এবং পিতা–মাতার প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে শিশুকাল থেকেই সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি চাহিদা অপূরণ রাখতে হয়। তাকে বুঝিয়ে দেয়া চায় যে, পৃথিবীতে চাইলেই সব পাওয়া যায় না। এতে করে ভবিষ্যত জীবনে কোন কিছু না পেলে বা কোন কাজে ব্যর্থ হলে সে একদম ভেঙ্গে না পড়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার শিক্ষা পেয়ে যেতে পারে।
৪শিশুর স্বাভাবিক যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে অতিযত্ন শিশুর জন্য ক্ষতিকর। এতে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বাধা পায়, সে অতিমাত্রার পর নির্ভরশীল হয়ে উঠে। তার ব্যক্তিত্ব ভালোভাবে মেলে না। অনেক পিতামাতা আছেন, যারা সন্তানকে দেখাশুনা করার জন্য, দুধ খাওয়ানোর জন্য অধিক সংখ্যক কাজের লোক রেখে দেন। শিশুর শরীরে একটু মাটির স্পর্শও লাগতে দেন না। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে দেশের মাটিও বায়ুর স্পর্শে বেড়ে উঠতে দিলে প্রাকৃতিক নিয়মে দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা সে লাভ করে। ফলে সে যখন তখন সাধারণ রোগজীবাণুর খপ্পড়ে পড়ে না। অতি যত্নের বিশেষ প্রবণতা বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে যাদের একটি মাত্র সন্তান আছে তার বেলায়। শিশুর ছোটখাট জিনিস পিতা–মাতা অস্থির হয়ে পড়েন ও ঘন ঘন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। শিশু বেশি মোটা–তাজা হচ্ছে না, কম খাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে এই জাতীয় সমস্যাই বেশি।
৪শিশুদের একা থাকতে না দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে তার নিজস্ব ভুবনে বন্ধু–বান্ধবদের সাথে মিশতে দিতে হবে। এতে সে হয়ে উঠবে স্বাবলম্বী, তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। কিন্তু বন্ধু নির্বাচনে পিতা–মাতাকে হতে হবে অত্যন্ত সচেতন। আজকাল যা দেখা যাচ্ছে খারাপ বন্ধু–বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে অনেক ছেলে–মেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
৪শৈশব কালে শিশুর ২ থেকে ৩ বছর বয়সের বন্ধুরা নিছক খেলার সাথী। এর পরে আসে স্কুলের প্রথম জীবনের বন্ধু। বিভিন্ন পরিবেশের, বিভিন্ন আর্থ–সামাজিক অবস্থার মধ্য থেকে এরা আসে। একজন আরেকজনের জন্য সব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকে। পিতা–মাতার সামাজিক মর্যাদা বা অবস্থানের কথা এদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না।
৪তবে জীবনের সবচেয়ে ক্রান্তিলগ্ন হলো কৈশোর। সময়টা বেশি স্থায়ী নয়। হঠাৎ করে ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠে, জামাকাপড় ছোট হয়ে যায়, গলার স্বরের পরিবর্তন ঘটে, কথাবার্তা, চালচলন বদলে যায়। এই বয়সের বন্ধুদের প্রভাব খুব বেশি ও আকর্ষণীয়। এই সময়ের বন্ধু নির্বাচনে ভুল হবার অর্থ সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেওয়া। স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে অন্য কোথাও আড্ডা মারে কিনা, খারাপ সঙ্গে পড়ছে কিনা তা কায়দা করে জেনে নিতে হবে, সরাসরি জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতে নাও চাইতে পারে। কিন্তু তখন ভেঙ্গে না পড়ে তাকে ভাল পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে নুতন বন্ধু–বান্ধবী যোগাড় করে দিতে হবে। কখনোবা, কুপ্রভাব থেকে সন্তানকে মুক্ত করার জন্য অভিভাবকের বাসস্থান পর্যন্ত পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে। এ সময় তাকে ভালো কাজের প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিতে হবে। মেধাবী ছাত্র–ছাত্রীদের সাথে পড়াশুনার প্রতিযোগিতা, খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে নিযুক্ত করতে হবে। ছবি আঁকা, গল্প, কবিতা লেখাসহ অন্যান্য সাহিত্যচর্চা বা বিজ্ঞান মনস্কতা জাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এর সাথে নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিতা–মাতা অভিভাবকদের সাথে করে নিয়ে গিয়ে সন্তানকে সুন্দর জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করানোর চেষ্টা করতে পারেন।
৪সর্বোপরি পিতা–মাতার উচিত শিশুর–শিক্ষক নির্বাচনে সতর্ক হওয়া। শিশুর জীবনে শিক্ষকের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। একজন শিশুকে উন্নত সুন্দর জীবনের অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ করতে একজন আদর্শ শিক্ষকই যথেষ্ট।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।