শিশুর মননশীলতার বিকাশে কাজ করতে হবে

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

শিশুদের মননশীল বিকাশ হলো তাদের বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং মানসিক গঠনকে ধাপে ধাপে বিকশিত করার প্রক্রিয়া। এটি শুধুমাত্র পাঠ্যবিষয়ক জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়; বরং শিশুদের চিন্তাশক্তি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক দক্ষতা এবং সজনশীল চিন্তাভাবনার বিকাশকেও অন্তর্ভুক্ত করে। একটি শিশুর মননশীল বিকাশ তার সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব, ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং সামাজিক সংহতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিশু মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবার হলো শিশুদের প্রথম শিক্ষক। শিশু যখন জন্মায়, তার শেখার প্রাথমিক পরিবেশ পরিবার। পিতামাতা শিশুদের প্রতি যত্নশীল, উৎসাহব্যঞ্জক এবং সহানুভূতিশীল থাকলে শিশু স্বাভাবিকভাবে তাদের চিন্তাশক্তি ও আবেগ প্রকাশ করতে শেখে। গল্পপাঠ, চিত্রাঙ্কন, খেলাধুলা এবং সৃজনশীল কার্যক্রম শিশুদের কল্পনাশক্তি ও মননশীল বিকাশকে উৎসাহিত করে। এছাড়া শিশুদের স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলে তাদের সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি আরও বিকশিত হয়।

বিদ্যালয় হলো শিশুদের দ্বিতীয় বিদ্যালয়, যেখানে তারা সমাজের সঙ্গে মেলামেশা করতে শেখে। শিক্ষকের দিকনির্দেশনা, প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা এবং বিতর্কমূলক পাঠক্রম শিশুদের সমস্যা সমাধান ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা বৃদ্ধি করে। দলগত কার্যক্রম ও সহপাঠী শিশুদের সঙ্গে সহযোগিতা শিশুদের সামাজিক দক্ষতা ও দলগত মানসিকতাকেও বৃদ্ধি করে। এভাবে বিদ্যালয় শিশুদের মননশীল বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সমাজ ও শিশুদের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। নিরাপদ, সহায়ক এবং সমৃদ্ধ সামাজিক পরিবেশ শিশুদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক বিকাশকে উৎসাহিত করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কার্যক্রম শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃত করে। সমাজ শিশুদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা তাদের সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে আরও সমৃদ্ধ করে।

শিশুদের মননশীল বিকাশের জন্য মূল উপাদান হলো উৎসাহ, স্বাধীনতা এবং অভিজ্ঞতার সুযোগ। অভিভাবক ও শিক্ষকরা যখন শিশুদের নিজের পছন্দ অনুযায়ী চিন্তা করতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেন, তখন শিশুরা কেবল বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে নয়, চরিত্রগত দিক থেকেও বিকাশিত হয় সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সামাজিক সংহতি শিশুর মননশীল বিকাশের অন্যতম প্রধান দিক।

শিশুদের মননশীল বিকাশের জন্য নিয়মিত উৎসাহ প্রদান করা, বিভিন্ন নতুন অভিজ্ঞতার সুযোগ তৈরি করা এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। শিশুদেরকে কখনোই অপ্রয়োজনীয় চাপ দেওয়া উচিত নয়; বরং তাদের শিখতে আগ্রহী করে তোলা, ভুল থেকে শেখার সুযোগ দেওয়া এবং সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তাদের চিন্তাশক্তিকে বিকশিত করা উচিত।

শিশুদের মননশীল বিকাশ হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সম্ভব। একটি সুস্থ, সৃজনশীল এবং বুদ্ধিমান শিশু আগামী সমাজের শক্তিশালী ভিত্তি গঠন করবে। শিশুদের বিকাশে আমাদের সচেতন মনোযোগই তাদের ভবিষ্যৎকে সৃমদ্ধ করবে এবং সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্র গঠনে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।।

আধুনিক মন মানসিকতা হলো একটি বহুমাত্রিক যোগ্যতার সমষ্টি যা শিশুকে ভবিষ্যৎ পরিবেশে সফল, সদয় ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিতে পরিণত করে। পিতামাতা, শিক্ষক ও সমাজ এবং সমাজের দায়িত্বশীলরা শিশুদের মনোজগত নিয়ে যারা কাজ করেন তারা যদি সচেতনভাবে এ দক্ষতাগুলো গড়ে তুলতে সহায়তা করে, তাহলে আগামী প্রজন্ম শুধু প্রযক্তি নির্ভর বা প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী হবে না, তারা হবে মানবিক, ন্যায়নিষ্ঠ ও উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয়ক। শিশুদের জন্য এটা কোনো বিকল্প নয়। এটি একটি জাতি সমাজ ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য প্রস্তুতি। আমরাও এ প্রস্তুতির অংশীদার।

পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ আছে যেখানে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণ হয় না কিংবা দক্ষতা যাচাই হয় না। শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে অর্থাৎ নিয়মিত মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দক্ষতা যাচাই হয়। শিক্ষার ভিত্তিটুকু শক্ত করতে হলে আমাদের প্রধানত তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। দক্ষ শিক্ষক, সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়মিত মনিটরিং। দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকদিন কোনো সংস্কার হয়নি। দিনের পর দিন একইভাবে চলতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাতে পারেনি। ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠ না দিয়ে, পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে গাইড বইনির্ভর একটি সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। যেটি পৃথিবীর অন্য কোনোদেশে দেখা যায় না। শিক্ষা ব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। মানুষের চাহিদা এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শ্রেণির ক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্রম বিশ্বব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। বলাবাহুল্য শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই শিক্ষার্থীদের আমরা আরেকটি ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছি। সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনপরিমার্জন করা এখন সময়ের দাবি।

সবচেয়ে বড় কথা হলো পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মাবাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না প্রথমেই সেদিকটা দেখতে হবে। তার পরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ নয়। বিশ্বমানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা দরকার। তাছাড়া পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসতে হবে। আমরা যদি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, তাহলে শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি এত সহজ কাজ নয় যে, চাওয়া মাত্রই সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিক্ষায় আরও মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি যারা মিথ্যাচার করে, জনমনে হতাশা ছড়ায়, তাদের বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে বৈষম্য দূর করতে হবে।

উন্নত বিশ্বের চিন্তাচেতনায় উন্নত করতে শিশুদের মানসিক বিকাশ জরুরি। এ বিষয়ে শিশুকে কিশোরদেরকে নিয়ে যারা কাজ করেন এবং লেখালেখি করেন তাদের দায়িত্ব অনেক। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও মননশীলতা তৈরির প্রয়োজনে শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে কাজ করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রস্তাবিত ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা: উপেক্ষিত জনআকাঙ্ক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধ‘সাহিত্যের মিত্র যদি হয় মনুষ্যত্ব…শত্রু হচ্ছে অমানবিকতা’