ডায়রিয়া কখন বলা হয়:
সহজ কথায় বলতে গেলে ঘন ঘন সাধারণত ২৪ ঘন্টায় ৩ বার তারও বেশিবার পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। মলে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হওয়া ডায়রিয়ার আবশ্যিক শর্ত। শুধুমাত্র মায়ের দুধ পান করে এমন শিশু অনেক সময় দিনে ৫–১০ বার পর্যন্ত পায়খানা করতে পারে যা পেস্ট–এর মতো সামান্য তরল, একে ডায়রিয়া বলা যাবে না। জলীয় ডায়রিয়া– মল খুবই পাতলা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারে পানির মতো। মলে কোনো রক্ত থাকে না। আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি– মলে রক্ত থাকে যা চোখে দেখা যায়।
ডায়রিয়ার কারণ:
কতকগুলি রোগজীবাণু খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে ডায়রিয়া ঘটায়। আমাদের দেশে যেগুলো হচ্ছে : ১. ভাইরাস–রোটাভাইরাস ২. ব্যাকটেরিয়া–ই–কোলাই, সিগেলা, ভিবরিও কলেরা ইত্যাদি ৩. প্যারাসাইট–এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা ও জিয়ারডিয়া।
কিভাবে ডায়রিয়া জীবাণু খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে:
খাদ্য বা পানীয় বস্তু। অপরিষ্কার হাত, গ্লাস, চামচ, বাসনপত্র বা সচরাচর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র। মল। মাছি ইত্যাদির মাধ্যমে।
ডায়রিয়ার পরিণতি : তাৎক্ষণিক–পানিস্বল্পতা এবং সময়মতো সুচিকিৎসা না পেলে অনিবার্য মৃত্যু। পরবর্তীতে–অপুষ্টি এবং রাতকানা, অন্যান্য রোগ।
নিয়ম– ১ পানিস্বল্পতা নির্ণয়:
ডায়রিয়াকালীন শিশুর শরীর থেকে পানি ও জলীয় অন্যান্য পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দেহে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। ডায়রিয়ার তীব্রতা এই পানিস্বল্পতার পরিমাণ বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। শিশুর অবস্থা লক্ষ্য করে এবং শিশুর পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিয়ে এই স্তরসমূহ নির্ণয় করে শরীরে পানি–ঘাটতির সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়।
সিদ্ধান্ত–পানিস্বল্পতা নেই:
শিশুকে লক্ষ্য করা: ক. অবস্থা–ভালো ও সজাগ খ. চোখ–স্বাভাবিক গ. চোখের পানি–রয়েছে ঘ. মুখ ও জিহ্বা–ভেজা ঙ. পিপাসা–স্বাভাবিকভাবে পানি পান করে তৃষ্ণার্ত নয়। পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিন–দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।
সিদ্ধান্ত–কিছু পানিস্বল্পতা: শিশুকে লক্ষ্য করা: ক. অবস্থা–অস্থির খিটখিটে*
খ. চোখ–বসে গেছে গ. চোখের পানি–নেই ঘ. মুখ ও জিহ্বা–শুকনো
ঙ. পিপাসা–তৃষ্ণার্ত, আগ্রহভরে পান করে* পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিন–ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।
শিশুর শরীর এসবের মধ্যে ২ বা ততোধিক চিহ্ন থাকলে এবং তার মধ্যে যে–কোনো একটি তারকাযুক্ত চিহ্ন থাকলে রোগী ‘কিছু পানিস্বল্পতা’ স্তরে আছে বোঝা যায়।
সিদ্ধান্ত-‘চরম পানিস্বল্পতা’
শিশুকে লক্ষ্য করা: ক. অবস্থা–অবসন্ন, নেতিয়ে পড়া, অজ্ঞান কিংবা ঘুমঘুম ভাব।* খ. চোখ–বেশি বসে গেছে এবং শুকনো। গ. চোখের পানি নেই। ঘ. মুখ ও জিহ্বা–খুব শুকনো। ঙ. পিপাসা–পানি পান করতেও কষ্ট হয় কিংবা একেবারেই পারে না।
পেটের চামড়া ধরে ছেড়ে দিন অত্যন্ত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়।
রোগীর দেহে এসবের মধ্যে ২ বা ততোধিক চিহ্ন আছে এবং তার মধ্যে যে কোনো একটি তারকাযুক্ত চিহ্ন থাকলে তবে শিশু ‘চরম পানিস্বল্পতা’ স্তরে আছে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
‘পানিস্বল্পতা নেই’–স্তরের রোগীর চিকিৎসা, পানিস্বল্পতা প্রতিরোধ:
ক. প্রয়োজনমতো খাবার স্যালাইন বা লবণ–গুড়ের শরবত–শিশুর বয়স যখন ২ বছরের কম প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ৫০–১০০ মি.লি. (আধা–১কাপ) প্রতি ১–২ মিনিটে ১ চামচ হিসেবে খাওয়াতে হবে। শিশুর বয়স ২ বছর থেকে ১০ বছরের মধ্যে হলে, প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর যতটুকু খেতে চায় চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে খেতে দিতে হবে। শিশু যদি বমি করে তবে মাকে ৫–১০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আবার খুব আস্তে আস্তে প্রতি ২–৩ মিনিট পরপর ১ চামচ করে খাওয়াতে হবে। শিশুর অন্তত ২ দিনের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইনের প্যাকেট মার কাছে থাকা উচিত।
খ. শিশু যতটুকু খেতে পারে ততটুকু অন্যান্য তরল খাবার খাওয়ানো যেতে পারে। যেমন–ভাতের মাড়, পানি, ডাবের পানি কিংবা শুধু পানি।
নিয়ম– ২ পুষ্টিহীনতা যাতে না হয় সেজন্য শিশুকে প্রচুর খাবার দেওয়া প্রয়োজন।
ক. বুকের দুধ চালিয়ে যেতে হবে এবং ঘন ঘন খাওয়াতে হবে। শিশু অন্য দুধে অভ্যস্ত হলে তাই খাওয়াতে হবে কমপক্ষে প্রতি ঘন্টা অন্তর অন্তর খাওয়াতে হবে।
খ. টাটকা খাবার–যে বয়সের জন্য যে খাবার স্বাভাবিক তা–ই খাওয়াতে থাকুন। উপযোগী খাদ্য–ডাল, ভাত, শাকসবজি, ডিম, মাছ, মাংস অথবা এসবের খিঁচুড়ি। খাবারের সাথে ১ বা ২ চামচ তেল মেশান। টাটকা ফলের রস : কলা বা পেঁপে চঁকিয়ে দিন। ৩–৪ ঘন্টা পরপর দিনে অন্তত ৬ বার খেতে দিন। খাদ্য নরম করে রান্না করুন যাতে সহজে হজম হয়।
নিয়ম– ৩
নিচের যে–কোনো একটি লক্ষণ দেখা গেলে শিশুকে শিশুচিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনেক বার পাতলা পায়খানা। বারবার বমি। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত। খাদ্য বা পানীয় গ্রহণে অনীহা। পায়খানায় রক্ত। চোখ বসে গেছে। যদি ৩ দিনের মধ্যেও অবস্থার উন্নতি না হয়।
কিছু পানিস্বল্পতা স্তরের রোগীর চিকিৎসা
প্রথম ৪ ঘণ্টায় আনুমানিক যে পরিমাণ খাবার স্যালাইন দিতে হবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাবার জন্য মাকে উৎসাহ দান। প্রতি ১ ঘণ্টা অন্তর অন্তর রোগীকে পরীক্ষা করা এবং পানি–ঘাটতির স্তর নির্ণয় করে ‘পানিস্বল্পতা নেই’ কিছু পানিস্বল্পতা/চরম পানিস্বল্পতা, রোগী কোন স্তরে আছে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
‘চরম পানি স্বল্পতার’ দ্রুত চিকিৎসা:
তৎক্ষণাৎ শিরায় স্যালাইন দিতে পারলে উত্তম। শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য ১০০ মিলি কলেরা স্যালাইন (যদি না থাকে নরমাল স্যালাইন) প্রয়োজন হবে। রোগী পান করতে সক্ষম হওয়ামাত্র খাবার স্যালাইন ও ৫ মিলি/কেজি/ঘন্টা হিসেবে দিতে শুরু করুন।