শিশুর আদর্শ জীবন গঠনে পারিবারিক শিক্ষা

ঝর্না বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৬ জুন, ২০২৪ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কয়েকটি পরিবার মিলে সমাজ গড়ে ওঠে। সংসার জীবনে মাতাপিতার চাওয়া সুস্থ সুন্দরভাবে সংসারধর্ম ফুলেফলে বৃদ্ধি করা। তাই শিশুর জন্ম প্রত্যেক পরিবারের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শিশুর জন্ম পরিবারের প্রাণকেন্দ্র, আনন্দদায়ক এবং পরিপূর্ণতা বলা চলে। আর পরিবারের মাবাবা তাদের সন্তানসন্ততিদের নিয়ে আনন্দে জীবনকে উপভোগ করে থাকে। প্রত্যেক মাবাবা চায় তাদের সন্তানেরা আদর্শবান মানুষ বা ভালো মানুষ হয়ে জীবন গঠন করবে। সন্তানের আদর্শময় জীবন যাপনের জন্য শিশুকাল থেকে ধর্ম শিক্ষা প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন। সাধারণত, দেশের প্রচলিত নিয়মে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ আসা থেকে ১৮ বছরের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সময়কালকে শিশু বলা হয়ে থাকে। শিশু, কিশোর, তারুণ্য, যুব, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ এভাবে মানবজীবনের প্রতিটি স্তরকে ভাগ করা যায়। পরিবারই মানব শিশুর প্রথম ও প্রধান পাঠশালা। পরিবারে মাতাপিতার দায়িত্বে ও স্নেহের বন্ধনে একজন ছোট্ট স্বর্গীয়, পবিত্র ও নিষ্পাপ শিশুকে পরম মমতায়, আদুরে ও ভালোবাসায় সত্য, সুন্দর ও নির্মলভাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা সর্বোতভাবে থাকা বাঞ্ছনীয়।

শিক্ষা হলো মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন। যে শিক্ষা মানুষের মনোজগত উন্নত করে, বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞান প্রবৃদ্ধি করে, সৃজনশীল বিকাশ সাধন করে এবং সর্বোপরি মনুষ্যত্ব বা মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন আদর্শিক মানুষ হিসাবে নিজেকে গঠন করে তাই হচ্ছে প্রকৃতশিক্ষা। একজন মানবশিশু জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রয়োজনে নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক ও বহুমাত্রিক যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাস্তব শিক্ষা লাভ করে থাকে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে, ‘মানব জীবন লাভ করা অতীব দুর্লভ’। আবার, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব’। এই দুর্লভ বা সেরা জীবনকে সার্থক ও অর্থবহ করতে হলে চাই আদর্শ জীবন গঠন। শিশুদের এমন আদর্শ জীবন গঠনে একমাত্র পারিবারিক বন্ধন থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ করে থাকে।

মানব শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম পাঁচটা বছর যা শিখে যেমন হাঁটা, চলা, বসা, কথা বলা, খাওয়াদাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, জীবন পদ্ধতি এবং আশে পাশে পরিবেশ সম্বন্ধে সেই শিক্ষা সারা জীবনের সাথে গেঁথে যায়। প্রকৃতির আলো, বাতাস, আকাশ, গাছপালা, ঝড়বৃষ্টি, নদীনালা, পশুপাখি প্রভৃতি থেকেও মানব শিশু শিক্ষা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ মায়ের কোলে শিশুর প্রথম হাতে কড়ি। ঘুম থেকে উঠা আর ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত একটা শিশুর করণীয় কর্তব্যগুলো ধাপে ধাপে মাতাপিতার কাছ থেকে আয়ত্ত করে। এতে করে পরিবারের আদর্শ শিশুর জীবনে প্রতিফলিত হতে থাকে। মাতাপিতার সততা, সৎ চিন্তা, সুন্দর চেতনা ও উপদেশ ধীরে ধীরে শিশুর মনে ধারণ করতে থাকে। পরিবারের কথা ও কাজের সমন্বয় থাকা চাই অন্যথা শিশুর কোমলমনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তাই পরিবারের কাছ থেকে সর্বদা শিশু সততা, সৎ চিন্তা, সত্যবাদিতা, মনের উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতা শিক্ষা লাভ করে। এভাবে পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, খেলার সাথী, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে আর নৈতিক শিক্ষায় মানব জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করে।

শিশুদের অন্তর্জগত অতি পবিত্র, নির্মল ও নির্ভেজাল প্রশান্তময় অবস্থা বিরাজমান থাকে। তাদের সুস্থ দেহ ও সুস্থ মনে যেই শিক্ষা দেওয়া হোক না কেন তা আনন্দ মনে গ্রহণ করে এবং মনোজগতে সহজে ধারণ করতে পারে। তাই জীবনের প্রারম্ভে শিশুকাল থেকে নীতিনৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণত দার্শনিকদের মতে,‘নৈতিকতা ধর্মের উপর নির্ভরশীল’। তাই শিশু বয়স খেকে স্ব স্ব ধর্মীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নীতিকথার সাথে পরিচিত করে তুলতে হবে।

এতে করে প্রতিটি শিশু স্বতন্ত্রভাবে বেড়ে উঠবে এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবন চরিতে সদাচার, শিষ্টাচার, ন্যায় পরায়ণতা, আদর্শবান, বিনয়ী, নম্রতা, ভদ্রতা ও মৈত্রীপরায়ণতা পরিলক্ষিত হবে। এভাবে পিতামাতা তাদের আদরের পুত্রকন্যাকে নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত রেখে সর্বদা ভালো কাজের আদেশ, উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করে ধর্মীয় আদর্শে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। শিশুকাল থেকে এমন ধর্মীয় বাতাবরণে প্রত্যেকের অন্তর্জগতে উন্নত মানসিক চিত্ত তৈরী হবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাপীঠেও শৃঙ্খলাবদ্ধ নিয়মিত পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হবে।

পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে ছবি আঁকা, গান শেখা, নাচ করা, আবৃত্তি, নাটক ও খেলাধুলার প্রতিও আগ্রহী করে তুলতে হবে। বিদ্যালয়, সংগঠন, ক্লাব, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত যে কোনও ছোটবড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে শিশুদের মননশীলতা বিকাশে সংস্কৃতি কর্মে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। তাদের মানসিক বিকাশ সাধনে মাতাপিতা, শিক্ষক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ভূমিকা অপরীসীম। এভাবে আজকের নতুন প্রজন্ম নৈতিক মূল্যবোধে জাগ্রত হয়ে আগামী দিনের বাংলাদেশের স্মার্ট সুনাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে।

উদাহরণ স্বরূপ বলতে চাই, সুখী দেশ হিসাবে খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট পাহাড়ী রাজতন্ত্র বিশ্বের ১৩৩তম ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ভুটান সত্যবাদিতার জন্য প্রশংসনীয়। কারো কোনও দ্রব্য অনুমতি ব্যতীত ধরে না। প্রতিটি শিশুকে পারিবারিক আদর্শে ও ধর্মীয় শিক্ষালয়ে পাঠদান করা হয়। এভাবে শিশুরা পারিবারিক আদর্শে মানবতাসম্পন্ন নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হবে। তাই শিশু মন থেকে ধার্মিকতা বা ধর্মপরায়ণ হওয়ার বীজ যথাযথভাবে বপন করতে পারলে নিঃসন্দেহে নীতিবান, আদর্শিক ও সুন্দর জীবন গঠনে মাতাপিতার অভিজাত সন্তান হয়ে দুর্লভ মনুষ্য জীবন মানবিক মূল্যবোধ, আলোাকিত, সার্থক ও পূর্ণতায় ভরে ওঠবে। জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সমুজ্জ্বল থাকলেই জীবন হবে সৎ, সুখী, সমৃদ্ধ, সুন্দর, নিষ্টাবান, দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি সর্বজন নন্দিত আত্মশুদ্ধির উৎকৃষ্ট মানবজীবন। আর এই উৎকৃষ্ট জীবন যাপনের জন্য শিশুকাল থেকেই নীতি নৈতিকতার শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই। তাই সকল শিশুর আদর্শিক জীবন গঠনে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী, লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভীষণ গরম!
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের পুরাকীর্তি সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে