শিশুবয়সে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার

ড. প্রণব কুমার চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ৩১ জুলাই, ২০২৫ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে শিশুকিশোররা ঝুঁকে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে। সমস্যা হলো, এটির ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি না থাকায় ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সব প্লাটফর্মে রীতিমতো আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা। টিকটক তো ব্যাধির আকার ধারণ করেছে।

বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারে মানুষ যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি এসবের অপব্যবহারে ক্ষতিকর প্রভাবও পড়ছে। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রাউজিং, চ্যাটিংয়ে পড়ালেখার ক্ষতি, মানসিক চাপ, নৈতিক অবক্ষয় তো আছেই, সঙ্গে বাড়াচ্ছে বিরক্তি, উদ্বেগ এবং আত্মসম্মানবোধের অভাব।

বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে বয়স কমপক্ষে ১৩ হতে হয়। তবে অধুনা তথ্যমতে, এখন ১০ থেকে ১২ বছরের ৫০ শতাংশ শিশুই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। ৭ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৩ শতাংশ।

এক সমীক্ষা জানায়, ৯৫ শতাংশ তরুণতরুণী এখন স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, যার মধ্যে প্রায় ৪৫ ভাগ সারাক্ষণ অনলাইনে থাকে। অর্ধেক অভিভাবক মনে করেন, ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের নৈতিক উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের বেড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এখন এই ব্যবহার কমানো চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিভাবকদের জন্য। এক কথায়এই অতি ডিভাইসপ্রীতি শিশুর সুস্থ বিকাশ ও মনোসামাজিক সুরক্ষার অন্তরায়।

শিশুদের কতটুকু ক্ষতি করছে সোশ্যাল মিডিয়া

অসামাজিকতা: শিশুমন ফ্যান্টাসি ও বাস্তব জীবনবোধ পুরোপুরি পৃথকভাবে চিন্তা করতে সমর্থ নয়। মিডিয়ামগ্নতা তাদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের সকল উপকরণ যেমনখেলাধুলা, কায়িক শ্রম, জনসেবামূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, পরিবারের জন্য সময় দেওয়া ইত্যাদি কেড়ে নিয়েছে। তারা গড়ে উঠছে অসামাজিক হয়ে।

আচরণজনিত সমস্যা: মারাদাঙ্গা দৃশ্য দেখতে দেখতে শিশু সামান্যতেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠার মতো আচরণজনিত সমস্যায় ভোগে। এসব দৃশ্য মাঝেমধ্যে দেখে থাকলে তেমন প্রভাব পড়ে না। তবে শিশু যদি নিয়মিত এসব দেখে, তবে সে পড়াশোনায় কম মনোযোগ, ‘ডানপিটে শিশুরোগে’র শিকার হয়। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবার পাশাপাশি টিভি, ম্যুভি আসক্তদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতাও বেশি। ছোট শিশুদের কেউ কেউ হতাশায় ভোগে।

অস্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া : সপ্তাহে একজন শিশু ১ ঘণ্টার বেশি টেলিভিশন দেখে থাকলে তার স্থূলকায় হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ২ শতাংশ বাড়ে। সে বসে বসে খায় বেশি ও মুটিয়ে যায়। পছন্দের তালিকায় বেছে নেয়মিডিয়াতে দেখতে থাকা বিজ্ঞাপ্তিত নানা অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড। যে শিশু বেশি টেলিভিশন দেখে, সে ফলমূলশাকসবজী কম খায়। তার হৃদযন্ত্র ও রক্ত সরবরাহতন্ত্র রোগের বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ফ্যাশন ম্যাগাজিন দেখে ও পড়ে, বয়:সন্ধিকালের শিশু নিজেদের ওজন ও ফিগার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। মডেলের অনুকরণে কন্যা শিশুরা দৈহিক শ্রম কম করে। ওজন কমানোর জন্য বিকৃত খাদ্যরুটিন বেছে নেয়। অসময়ে খাওয়াদাওয়া স্বাস্থ্যের ওপর কুপ্রভাব ফেলে।

সাইবারবুলিং: সোশ্যাল মিডিয়ায় সবধরনের তথ্যই সামনে চলে আসে। যা নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও সম্ভব নয়। যে কারণে শিশুরা যেকোনো সময় তাদের বয়সের তুলনায় অনুপযুক্ত এবং ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা লাভ করছে। যা তাদের চিন্তা ভাবনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যমে বাড়ছে সাইবারবুলিংয়ের মতো ঘটনা। এটি শিশুদের মনে যেমন ভয় ও লজ্জা ছড়ায়, তেমনি তাদের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলে।

পড়াশোনার ক্ষতি: সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়লে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। এতে পড়াশোনার মারাত্মক ক্ষতি হয়। যদি বাচ্চাদের সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে তাদের বাড়ির কাজ করতে বলা হয়, তাহলে তারা বাবামায়ের প্রতি বিরক্তি বা হতাশা প্রকাশ করে।

চোখের দৃষ্টিশক্তি: শিশুরা যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে তখন তাদের চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, যাকে বলে ‘মায়োপিয়া’। প্রাথমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাওয়ারফুল চশমা পড়ে অনেক শিক্ষার্থী ।

১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য নিষিদ্ধ

* অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিষিদ্ধে বিল পাস হলো দেশটির পার্লামেন্টে। শিশুরা যাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটির নাম ‘দ্য সোশ্যাল মিডিয়া মিনিমাম এজ’।

* দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এই আইন প্রয়োজন। আমরা শিশুদের নিরাপত্তা এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছি। এই আইন আমাদের শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সুস্থ অনলাইন পরিবেশ তৈরি করবে।

* অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা বলেছেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করেন। অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম সংবাদমাধ্যম রূপার্ট মারডকের নিউজ কর্প ‘লেট দেম বি কিডস’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এই আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে। দেশটির শিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন।

* প্রত্যেক দায়িত্ববান সরকারই শিশুদের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সংগ্রাম করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো, যেমনফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু দেশ ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য বয়সসীমা আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে বেশকিছু দিন ধরেই নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

* বিষয়টিকে কেউ ভালোভাবে নিলেও অনেকেই আবার সমালোচনা করেছেন। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক টোবি মারে বলেছেন, ‘আমরা জানি যে বর্তমানে বয়স যাচাইকরণ যে পদ্ধতিগুলো আছে তা নির্ভরযোগ্য নয়। এ প্রক্রিয়াকে সহজেই ফাঁকি দেওয়া যায়। এটি ব্যবহারকারীর গোপনীয়তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’

উপসংহার

* বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা বেশ ব্যাপক। এটি বন্ধু, পরিবার এবং পরিচিতজনদের সাথে সহজে যোগাযোগ স্থাপন, চলমান বিশ্ব এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়া, ভিডিও, ছবি, এবং বিভিন্ন বিষয় শেয়ার ও দেখা প্রভৃতি বিনোদনের অনন্য আধুনিক প্রযুক্তি। তবে অনেক সুবিধার বিপরীতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমনউদ্বেগ, বিষন্নতা, একাকিত্ব; সাইবার বুলিং, অপপ্রচার ও ভুয়া খবর, গোপনীয়তার ঝুঁকি, বয়সের সাথে সঙ্গতিহীন বিষয়বস্তুর সংস্পর্শ, এবং সময়ের অপচয় এসব নেতিবাচক প্রভাবসমূহ শিশুবয়সের জন্য মারাত্নক হুমকিস্বরূপ। অনলাইনে তরুণদের সুরক্ষিত রাখা জরুরি। আবার ডিজিটাল বিশ্বে তাদের অন্তর্ভুক্তও করা দরকার। এই নিষেধাজ্ঞা শিশুদের গোপন এবং অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন স্পেসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

* অতিরিক্ত সোশ্যাল সাইট নির্ভরতা মানেই হলো অতিরিক্ত ডিভাইস নির্ভরতা। অভিভাবকদের উচিত, ডিভাইস থেকে দূরে রেখে শিশুদেরকে নিয়মিত খেলাধুলার অভ্যাস করা। পড়াশোনার বা প্রয়োজনের বাইরেও কিছু সময় তারা অভিভাবকের সমন্বয়ে সামাজিক সাইটগুলোতে থাকতে পারে। তবে তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়।

লেখক : চিকিৎসাবিদ, প্রাবন্ধিক; সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানব পাচারের কারণে বিদেশে সংকুচিত হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রম বাজার
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম