প্রখ্যাত লেখক ও কবি অস্কার ওয়াইল্ড’র একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। তিনি বলেছেন ‘ শিশুদের গড়ে তোলার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল তাদের আনন্দ দেয়া।’ শিশুদের পাঠদানের বিষয়েও স্কুলে স্কুলে আনন্দময়তার উপর ইদানিং বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ শিশুরা ভয়হীন জগত পাবে, আনন্দে বেড়ে উঠবে। মূলত আজকের শিশু আগামী বিশ্বের কারিগর। সারা বিশ্বে ভবিষ্যত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু শিশুরা। তাদের উপর নির্ভর করবে আগামীর পৃথিবী কেমন হবে। তাই শিশুদের বেড়ে উঠার প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শিশুকালকে কিভাবে আকর্ষণীয় ও অর্থবহ করা যায়। ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থা শিশুদের কল্যাণে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী নগরজীবন, দুর্বৃত্তায়ন, যুদ্ধবিগ্রহ, বাণিজ্যিক লোভ, শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক উষ্ণতাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ শিশুদের সুষম বেড়ে উঠার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রান্তিক অংশীজন হিসেবে এতে শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রযুক্তির বিরুপ প্রভাব তথা অপব্যবহারের করুণ শিকার শিশুরাই বেশি। করোনাকাল সে মাত্রাকে বাড়িয়েছে বহুগুণ।
গত ডিসেম্বরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পর্যায়ক্রমে বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়, মাঠে খেলাধুলা, আড্ডা, বেড়ানো সব বন্ধ হয়ে যায়। ঘরবন্দী হয় শিশুরা। ঘরবন্দী শিশুদের সময় কাটানোর অনুষঙ্গ হয় প্রযুক্তি তথা মোবাইল, কম্পিউটার ও টিভি। এছাড়া স্কুলগামী শিশুদের প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। ফলে কিছু শিশুকে বাধ্য হয়ে এসবে সময় কাটাতে হচ্ছে। প্রযুক্তিবিদ বা বিশেষজ্ঞরা শিশুদের প্রযুক্তির নেশা হতে দূরে রাখতে পরামর্শ দেন। প্রযুক্তির নেতিবাচক আসক্তি শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত করে। কিন্ত করোনা কালে অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়ে শিশুদের মোবাইল কম্পিউটার হাতে দিতে হচ্ছে। ইন্টারনেট পৃথিবীকে গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছে। শিশুরা মজাদার ও নেতিবাচক বিষয়গুলোতে সহজে আকৃষ্ট হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটাচ্ছে। এমন কিছু গেমিং এ আকৃষ্ট হচ্ছে যা শিশু মানসে থ্রিলিং, হিংস্রতা বা অতিমানবের ধারণা জন্ম দিচ্ছে যা বাস্তবের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
মোবাইল বা কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানো ফলে কিছু শারীরিক সমস্যাও বেড়ে যেতে পারে। চোখের সমস্যা, স্থুলতা, শারীরিক অবসাদগ্রস্থতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া যা পরবর্তী জীবনে শিশুর বিকলাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার কারণ হতে পারে। এছাড়া প্রযুক্তি আসক্তির মানসিক ক্ষতিও কম নয়। শিশু বয়সে মানবিকতা লোপ পাওয়া, অসম্ভবের পিছনে ছুটা বা পাওয়ার নেশা, দলীয় বা সামাজিক কাজে অনিহা, নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা ভাবা, মানসিক দৃঢ়তা হ্রাস বা অস্থিরতা, নেতিবাচক মানসিকতা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এসময়ে অভিভাবকদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া জরুরি। শিশুরা যাতে মাত্রাতিরিক্ত সময় ইলেকট্রনিকস ডিভাইস নিয়ে পড়ে না থাকে। মোবাইল কম্পিউটার চালালেও ওরা কোন ধরণের প্রোগ্রামের প্রতি আসক্ত তা খেয়াল রাখা। বর্তমানে এসব থেকে শিশুদের একেবারে দুরে রাখা সম্ভব নয়, তাই যতটুকু পারা যায় তাদের শিশুতোষ শিক্ষণীয় এ্যাপসে অভ্যস্ত করতে হবে। কোনভাবেই নোংরা বা অতি মানবিক কোন সাইট দেখা যাবে না, একাকী বা রাতে তাদের হাতে মোবাইল দেয়া উচিত নয়। ঘরবন্দী এসময়ে প্রযুক্তি আসক্তি কমানোর জন্য মা -বাবাকে তাদের সাথে বেশি সময় দিতে হবে, তাদের সাথে খেলতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, একসাথে খাওয়ার অভ্যাস করা ও কিছু সময় তাদের সাথে গল্প করা। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলার সরঞ্জাম দিয়ে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। শারীরিক ফিটনেস ধরে রাখতে নির্দিষ্ট সময় ঘরে ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা যায়, পাশাপাশি সুষম খাবার দিতে হবে। অভিভাবক সচেতন হলে এবং সময় দিলে শিশুদের প্রযুক্তির নেতিবাচক আসক্তি বহুলাংশে কমানো সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব হতে কিভাবে বাঁচা যায় তা ভাবতে হবে, বিশেষত শিশুদের। আগামীর বাসযোগ্য যে পৃথিবীর স্বপ্ন আমরা দেখি তার নেতৃত্ব দিবে আজকের শিশু। করোনার এ অন্তর্বর্তীকালীন তাদের যেকোন নেতিবাচক আসক্তি সে যাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে। তাই সচেতন হলেই মিলবে উপায়।