শিশির থেকে শবনম : এক বিপ্লবী নারীর কীর্তিগাথা

বিপ্রতীপ অপু | মঙ্গলবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ড. অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম। নামের সাথেই জড়িয়ে আছে তাঁর সমৃদ্ধ পরিচয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন সুলেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বকীয়তায়। তাঁর বক্তব্য যেমন সাবলীল। লেখনীও তেমনি সহজ, সরল এবং মার্জিত। না গল্পে, না কলামে মেদহীন লেখায় তিনি সিদ্ধহস্ত। সাহিত্যে নান্দনিক অথচ সহজতার চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করতে গিয়ে দুর্বোধ্য আর কঠিন শব্দচয়নে সাহিত্য রচনা পাঠককে সাহিত্যে মনোনিবেশ করাতে পারে না। অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম তাঁর সাহিত্যকর্মে এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পেরেছেন। আর এতেই তাঁকে অনেকের মাঝে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়।

অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারীকে নিয়ে লেখা ‘শিশির থেকে শবনম’ গ্রন্থটি তাঁর সাহিত্য কর্মের আরেকটি মাইলফলক। নেতাজী সুভাষ বোসের আদর্শে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে যে ক’জন নারী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে মন প্রাণ উজাড় করে অকুণ্ঠ সমর্থন যুগিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকটা অবহেলায় ইতিহাসের পাতায় স্থান না পাওয়া একজন নারী শবনম খানম শেরওয়ানী। তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে অসংখ্য কীর্তি। বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্তের স্নেহধন্য ‘শবনম’ কি করে শিশির কণা গুহ থেকে শবনম খানম শেরওয়ানিতে পরিণত হলেন সেও এক অন্য রকম গল্প।
ডা. খাস্তগীর স্কুলে অধ্যয়ন এবং আর্য সঙ্গীতের ছাত্রী হিসেবে দু’জন বিপ্লবী নারীর সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তাঁর ভেতর প্রোথিত হয় স্বাধীনতার চেতনা। সে সুবাদে কংগ্রেস মহিলা শাখার সম্পাদিকাও নির্বাচিত হন। ছিলেন নেতাজী সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড ব্লকের সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। আবার মহাত্মা গান্ধীরও নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী ছিলেন।
সে সময়েই তাঁর প্রতিভা একে একে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তৎকালীন বাঙালি সমাজের সকল প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শবনম খানম শেরওয়ানী রাজনীতি, শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা এবং সমাজ সংস্কারে সাহসের সাথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্বমহিমায়। অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্টের এই নারী শত প্রতিকূলতার মাঝেও কী করে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পরিবার, সমাজ এবং দেশের প্রতি আপন দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয় তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
শবনম খানম শেরওয়ানী একজন বহুগুণে গুণান্বিত নারী ছিলেন। রাজনীতি থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞান অব্দি প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য সফলতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি রাজনীতি, শিক্ষা, সংগীত, সাংবাদিকতা, সাহিত্যকর্ম কিংবা চিকিৎসায় নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন একজন সফল নারী হিসেবে। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে তাঁরই রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং বিপ্লবী নেতা লোকখান খান শেরওয়ানীকে কারাগারে উপস্থিত হয়ে বিয়ে করে নিজেকে একজন সাহসী সমাজ সংস্কারক হিসেবে প্রমাণ করেছেন।
পঞ্চাশের দশকে একটি রক্ষণশীল সমাজে একজন নারীর পক্ষে সাংবাদিকতা, সাহিত্য চর্চা, সংগীত বা বেতারে কথক হিসেবে কাজ করা দুঃসাহসী কাজই ছিল। সেই প্রতিকূল সময়ে শবনম খানম শেরওয়ানী ছিলেন আপন আলোয় দেদীপ্যমান। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং বেতারের কথক। তাঁর মতো বিদূষী নারীর জীবনগাথা তুলে আনা সত্যিই সাগর সেঁচে মুক্তো সংগ্রহের মতোই এক দুরূহ কাজ। অনেকটা নিকষ কালো অন্ধকারে আলো হাতড়ানোর মতো। সেই কষ্টসাধ্য কাজটিই করেছেন সুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম। ইতিহাস বঞ্চিত একজন মহীয়সী এবং বিপ্লবী নারী শবনম খানম শেরওয়ানীকে কোনো ভাব সাহিত্যের আশ্রয় ব্যতিরেকে সরাসরি তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব ধারায়।
নিপুন প্রচ্ছদের কারিগর উত্তম সেনের করা চমৎকার প্রচ্ছদে স্বনামধন্য প্রকাশনা শৈলী থেকে প্রকাশিত ড.অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলমের শ্রমলব্ধ গ্রন্থ ‘শিশির থেকে শবনম’ একজন অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারী তথা সমাজ সংস্কারক নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ইতিহাসে স্থান করে দিতে অকৃপণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি বলতে চাই, দেখতে চাই, শুনতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধই-কমার্স ব্যবসাকে মানুষের আস্থায় নিয়ে আসা উচিত