শিল্প বাণিজ্য বিকাশের পথিকৃৎ এ কে খান স্মরণে

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ | বৃহস্পতিবার , ৩১ মার্চ, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ


পথিকৃৎ হিসেবে দেশের শিল্প বাণিজ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান যার , তিনি আবুল কাশেম খান ( ১৯০৫-১৯৯১) যিনি এ.কে খান নামে ছিলেন খ্যাত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ার অন্যতম কীর্তিমান কারিগর, দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও রাজনীতির উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক জনাব এ.কে. খান এর জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প পরিবার প্রতিষ্ঠা। এ.কে খানই প্রথম বাংলাদেশী মুসলমান যিনি এতদঞ্চলে শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারে এগিয়ে আসেন । বেঙগল সিভিল সার্ভিসে বিচার বিভাগের অতি সম্মানীয় চাকরী ছেড়ে দিয়ে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এ কে খান কোম্পানী লিমিটেড। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সময়ে টেঙটাইলস, শিপিং, পাট, ইলেকট্রনিক মটরস, ম্যাচ ও পলিউড, প্রথম বাঙালী ব্যাংক সহ বহুসংখ্যক শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় শিল্পায়নের ক্ষেত্রে রাখেন অনন্য অবদান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্প এলাকা গড়ে তুলে স্থানীয় পুঁজি ও শ্রম নিয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য।
দেশের শিল্পায়নে তিনি যে পথ প্রদর্শন করে গেছেন সেই পথে বাংলাদেশের অসংখ্য উদ্যোক্তা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে। তার প্রতিষ্ঠিত কল কারখানায় হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হয়েছে, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরী হয়েছে এবং ভাবীকালে তারা নিজেরাও শিল্প বানিজ্য বিনিয়োগ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সততা নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সাথে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার জন্য এ কে খান কোম্পানীর সুনামই অন্যতম পুজি। তাঁর শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-মালিক সৌহার্দ্য সবার জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।
মুসলমানদের জন্য আলাদা স্বাধীন আবাসভূমির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি, এজন্য বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হন আবুল কাশেম খান। ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য জনাব খান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনসের (পি.আই.এ) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আইন সভার সদস্য হন। ১৯৫৮ সালে পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের মন্ত্রী সভায় যোগদান করেন এবং শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ বিভাগের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পুর্বপাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উপেক্ষা ও পক্ষ পাতিত্বের প্রতিবাদে ১৯৬২ সালে পদত্যাগ করেন।আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভার অন্যতম বাঙালী সদস্য কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী বিচারপতি মুহাম্মদ ইবরাহিম তার ডায়েরীতে লিখেছেন ১৯৬২ সালের সংবিধান রচনা ও মূল্যায়নে এবং দেশের দু’অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়াস নেন এবং দেশের দু’অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের প্রয়াস নেন, রাখেন বিশেষ অবদান। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন। বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়ে পাক-ভারতের মধ্যে সিন্ধু পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়। শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বস্ত্র ও পাট শিল্পের দ্রুত প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ । এখানে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা, কর্ণফুলী রেয়নমিল স্থাপনএবং পশ্চিম পাকিস্তানেও অনুরূপ শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দেশের প্রতি জেলায় শিল্প এলাকা প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় পুঁজি ও শ্রমিক আকর্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ছোট ও মাঝারি শিল্প স্থাপণে বিশেষ গুরুত্বারোপ ছিল তার। তৎকালীন সরকারের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। বৈদেশিক ঋণ অনুদান, বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার , শিল্প ও বাণিজ্য বান্ধব নীতি নির্দেশনা গ্রহনের ব্যাপারে তার পরামর্শ প্রস্তাব ভাবীকালে দেশ ও অর্থনীতিকে ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী করে তোলে।
করাচির পর রাওয়াল পিন্ডিতে নিখিল পাকিস্তানের রাজধানী স্থানান্তরিত হলে ঢাকায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের প্রস্তাব প্রদান করেন এ কে খান। যুক্তি যাতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখানে বসতে পারে এবং অধিবেশনকালে কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ এখানে চলতে পারে। এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ঢাকায় শেরে বাংলা নগর স্থাপিত হয়। এ কে খান মন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, বনশিল্প কর্পোরেশন ও পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক স্থাপিত হয়।১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর অত্যাচারের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান করেন। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বহির্বিশ্বের উদ্দেশ্যে পাঠের জন্য ইংরেজীতে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রণয়ন করেন যা মেজর জিয়ার (শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া) কন্ঠে ঘোষিত হয়।
বৃটিশ আমলে পূর্ববঙ্গ শিল্প-বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত এবং কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আমলে অবাঙ্গালীদের হাতে শিল্প কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এ অবস্থায় এ. কে. খান এদেশের শিল্পায়নে প্রথম বাঙ্গালী মুসলমান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে তাঁর প্রথম কারখানা এ.কে খান ফ্যাক্টরী’ স্থাপন। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিল্প স্থাপন। ষাট দশকের দিকে তাঁর অন্যতম বড় শিল্প ‘চট্টগ্রাম টেক্সটাইল মিলস’ প্রতিষ্ঠা
তাঁর শিল্প-কারখানায় শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক আদর্শ স্থানীয়। শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণের জন্য শিল্পে শ্রমিকদের শেয়ার প্রদানের পক্ষপাতী। বিশেষতঃ তিনি শিল্পোদ্যোক্তা, শ্রমিক ও অর্থযোগানদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ত্রিমুখী অংশীদারীত্বের কথা বিবেচনা করতেন। বাঙ্গালী মালিকানাধীন প্রথম ব্যাঙ্ক ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) প্রতিষ্ঠা।। বিভাগোত্তরকালে তিনি যখন দেখলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারী প্রধান শিল্প কারখানাগুলির মালিক প্রায় সকলেই অবাঙ্গালী এবং বাঙ্গালী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিল্পোন্নয়নে তথা অর্থনৈতিকক উন্নয়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগেরর প্রচন্ড অভাব, তিনি তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য এক সাহসী উদ্যোগ গ্রহন করেন এবং জাতীয় উন্নয়নে একজন অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। এই পথ কঠিন ও কন্টকাকীর্ণ ছিল, বিশেষ করে এ. কে. খানের মত একজন নীতিবান এবং সততায় অটল ব্যক্তির জন্য। তাঁকে এজন্য যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছে। তাঁর এই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি যখন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন, শিল্পায়নে শিক্ষিত ব্যক্তির উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদানে তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টা বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী পরিচালিত প্রথম ব্যাংকের স্থপতিও জনাব আবুল কাসেম খান। পাকিস্তানের উন্নয়নে ‘ইন্ডাষ্টিয়াল এষ্টেটে’র ধারণা আবুল কাসেম খানের মস্ত বড় দান। তিনি বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানের মত একটা প্রাচ্য দেশের পক্ষে পাশ্চাত্যের ন্যায় পুঁজির সেই ভূমিকা ও সুযোগ লাভ করে উন্নতির ঐরূপ প্রচুর সময় পাওয়া যাবে না। সুযোগের সঙ্কোচন সত্ত্বেও দেশকে কে অতি অল্প সময়ের মধ্যে উন্নয়নের প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণ হওয়ার প্রত্যাশী ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের ন্যায় এরূপ সুফলা জমি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এদেশের মানুষের চরিত্রের এক প্রধান দিক হল জমির প্রতি মমত্ব। তার এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে। এই যে লোকে গ্রাম ছেড়ে শহরের পথ ধরেছে , কাসেম খান এই প্রবণতাকে অত্যন্ত ভয়াবহ মনে করেন। এর ফলে বহু নতুন সমস্যা, নূতন সঙ্কটের সৃষ্টি হবে । প্রাচ্যের জীবন-দর্শনের প্রতি এটি একটি মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে।
এসব কিছুর উত্তর হল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এষ্টেট। প্রত্যেক জেলায় এবং প্রত্যেক মহকুমায় এরূপ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এষ্টেট স্থাপনই আবুল কাসেমের লক্ষ্য ছিল। তিনি বলেনঃ কয়েকজন বৃহৎ পুঁজিপতি শিল্পকে কেন্দ্রীভূত করলে সমস্যার সমাধান হবে না। শিল্পকে প্রসারিত করে সাধারণ মানুষকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি মনে করতেন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এষ্টেটে বহু ক্ষুদ্র ও কুটির-শিল্পের সমাবেশ করা যাবে। এখানে শিল্পের মালিকদের জমি, বাড়ি-ঘর, কারখানা, বিজলী, ব্যাঙ্ক, কাঁচা মালের সরবরাহ, উৎপন্ন জাতের বিক্রয় ব্যবস্থা- সব কিছুর সুবিধা দেওয়া হবে। বাজার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, স্কুল সব কিছু মিলিয়ে এস্টেএষ্টেটগুলি হবে স্বয়ং-সম্পূর্ণ এলাকা। তিনি বলতেন .সাধারণ মানুষের উপকার করতে পারব এই আশায় আমি মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করিয়াছিলাম।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লোকের ঔপনিবেশিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়নকে ব্যাহত করে। পশ্চিম পাকিস্তানে ভারী ও ব্যয়বহুল শিল্প কারখানার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদারভাবে অর্থ বরাদ্দ করত কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বেলায় তা ছিল বিপরীত। বৈদেশিক বাণিজ্য পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল শতকরা ৫৯ ভাগ কিন্ত ঐ আয় হতে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় করা হত শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ। পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১৭% আর পশ্চিম পাকিস্তানে তার পরিমাণ ছিল ৮৩%। এই ক্রাান্তি লগ্নে এ.কে. খান ১৯৮৫ সালের ২ শে অক্টোবর পাকিস্তান সরকারের শিল্প, বিদ্যুৎ ও পূর্ত মন্ত্রী হিসাবে কার্য্যভার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালের মে মাস পর্য্যন্ত ঐ পদে বহাল ছিলেন। তাঁর কার্য্যকালের সময় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনায় শিল্প সেক্টর বহুলাংশে তাঁরই ইচ্ছামত প্রণীত হয়। উপরোক্ত বৈষম্যমূলক আচরণ এ.কে. খানকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। ১৯৬০ সাল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ.কে. খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি এক সভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তান শিল্পে অনুন্নত, এইখানে মূলধনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে এবং এখানে বিনিয়োগের সুবিধা প্রচুর। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ছিলেন জেনারেল আযম খান।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব। এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাধীনতা, ভুট্টোর মিথ্যাচার ও বিস্মৃতপ্রায় গণহত্যা
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল