বইয়া যাওরে কর্ণফুলী
চট্টগ্রামের পরে নদী চট্টগ্রামের পরে
তুমি ডুবাও কিবা ভাসাও তোমার
যাহা মনে ধরে নদী যাহা মনে ধরে
বারোজন আউলিয়া আছেন এ জেলায় ঘুমাইয়া
শেখার বয়ন শুরু করি তাদের দোয়া নিয়া
(ইকবাল হায়দার)
বাংলাদেশ উড়ন্ত পাখীর মত একটি মানচিত্র। শীর্ষ দেশ উত্তর বঙ্গ। মায়াবী পুচ্ছের মত চট্টগ্রাম। মনে হয় নীল সুদর্শনা মাছ রাঙ্গা সমুদ্র থেকে এই মাত্র স্নান সেরে উড়াল দিয়াছে। প্রকৃতির প্রধান উপকরণরূপে বন–বনানী, পাহাড়–হ্রদ, নদী ও সমুদ্রকে ভাবা হয়। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করি এ সকল উপাদানে পরিপূর্ণ চট্টগ্রাম, মধ্যে জরির ফিতের মত চক চক করে উঠে কর্ণফুলী।
অপূর্ব সব শব্দের গাঁথুনী প্রাকৃতিক দৃশ্য কাহিনীর অনবদ্য বিন্যাস বর্ণনার মুন্সীয়ানায় লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীর তুলিতে কর্ণফুলী হয়ে উঠেছে জীবন্ত কীংবদন্তী। কর্ণফুলী আমাদের প্রাণের নদী। চট্টগ্রামের সমাজ –সংস্কৃতির সংঙ্গে মিলে মিশে একাকার এ নদী। এ অঞ্চলে মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে এ নদী যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত তেমনি তার রূপ বৈচিত্রে ও সৌন্দয্যে মাতাল হয়েছেন আমাদের শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকরা। আমাদের গানে, গল্পে, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে যেমন কর্ণীফুলীর জয় জয়গান আমরা প্রত্যক্ষ করি তেমনি ছড়া ও কবিতায় প্রবলভাবে প্রবাহিত এ নদীর স্রোতধারা। কবি আবদুল মতিন রিপন তার “ও কিশোরী কর্ণফুলী” কবিতায় লিখেই ফেললেন তাঁর অসাধারণ অনুভূতি।
“অবাক চোখে দেখি যে তোর স্রোতের শিল্পকলা”
নদীর বন্দনায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত “কপোতাক্ষ” কে করেছেন মহিমান্বিত, বিশ্বখ্যাত। বাঙালির মানসপটে এঁকে দিয়েছেন নদীর অনুপম সৌন্দর্য। নওগাঁ জেলায় অবস্থিত কুঠিবাড়ি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘নাগর’ নদীকে দেখেই পদ্মাপ্রিয় বিশ্বকবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’। এমনি করে কবি জীবনানন্দ দাশ ‘ধানসিঁড়ি”, অদ্বৈত মল্লবর্মন ‘তিতাস’, শামসুর রহমান ‘মেঘনা’ প্রভৃতি নদীকে উপলক্ষ করে নদীকে করেছেন বিখ্যাত, নিজেরাও হয়েছেন খ্যাত।
নদীর গপ্পো–নদীমাতার কিস্সা– এভাবেই ঠাঁই করে নিয়েছে মানবহৃদয়ে, শিল্প সাহিত্যের শাখায় শাখায়। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কবিতা– ছড়া–গান–উপন্যাসে সব জায়গায়। বর্ণিল চিত্রে, বিস্তারিত বর্ণনায়, রঙদার বৈভব–সম্পদে। অঙ্কিত হয়েছে নন্দিত চিত্রমলা। পরিবেশিত হয়েছে নাটক। প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্র।
কর্ণফুলীর কারনে চট্টগ্রামের প্রকৃতি যেমন অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র, তেমনি মানুষগুলোর চরিত্র ও স্বতন্ত্র, উদার, মহৎ, সাহসী, সরল, আন্তরিক, কুটকৌশল বিহীন ও একই সংগে কল্পনা প্রবণ এবং বৈষয়িক।
এই কর্ণফুলীর নদীর ঐতিহ্য হচ্ছে, “সাম্পান”। এটি নৌকা বিশেষ, সামান্য বাঁকানো কাঠামোর চেপ্টাতলা যুক্ত। জোয়ার ভাটার স্রোতে ভোর থেকে গভীর রাত অবধি কে কোরত, কে কোরত শব্দে মুখরিত দুই পাড়। দুই পাড়ের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী এ শব্দ শুনতে অভ্যস্ত। অনেক মানুষের জীবন– জীবিকা, অর্থনীতি, সুখ–দুঃখ জড়িত এই সাম্পানের সাথে। আছে ঘটনা, দুর্ঘটনা। দুই দাঁড়, এক মাঝি, এর চালকই ‘সম্পানওয়ালা’। বহমান এই কর্ণফুলীর কারনে আজও বেঁচে আছে অনেক মানুষের জীবন স্পন্দন।
এই নদীর উৎপত্তির অনেক ইতিহাস, গল্প, কল্প–কাহিনী আমরা জানি তবে শিল্প সাহিত্যে নানান জনের নান্দনিক উপস্থাপনা, বিবৃতির কারনে তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী হয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এক কথায় অসাধারন। ১৬১ কিলোমিটার পথচলা এই নদীর দু’পাশে হাজারো বর্ণিল দৃশ্য চোখে পড়ে সকলেরই। এই মনোরম সৌন্দর্যে যে কারোরই দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। কর্ণফুলী নদীর এই ভরা যৌবন দেখে প্রেমে পড়েননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কবি, সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, প্রকৃতি বিশারদ চিত্রকর থেকে শুরু করে সবাই এই নদীর মোহনীয় সৌন্দর্য্যে মাতোয়ারা হয়েছেন আর রচনা করে গেছেন কবিতা, গান, কিংবা গল্প– উপন্যাস।
কর্ণফুলীর অপার সৌন্দর্য ধরা পড়েছে শিল্পীর তুলির মনোরম আঁচড়ে। কর্ণফুলী তার ঢেউয়ের দোয়ায় সৌন্দর্য্যের যে স্নিগ্ধ পসরা সাজায় তা আরো সুন্দর ও চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়। চিত্রশিল্পীর তুলির পরশে।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ও গবেষক ইকবাল হায়দার এর রচিত নিম্মোক্ত গানের কথায় ঠিক এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
‘কি রূপের বাহারে
কর্ণফুলীর পাড়ে
ঝলমল ঝলমল করে
আমার চট্টগ্রাম শহর”
নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে নদীর সংখ্যা মোটামুটি সাতশোটির মত। দেশের অন্যান্য প্রধান নদীর মত অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ নদী “কর্ণফুলী”
শহর বাদেও গোটা চট্টগ্রাম অঞ্চলই সামগ্রিকভাবে কর্ণফুলীর নদীর সাথে অতি নিবিড়ভাবে একাত্ন হয়ে মিশে আছে। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তা– চেতনা, মানসিকতা, কৃষ্টি– শিল্প– সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পৃক্ত হয়ে আছে এই কর্ণফুলী নদীর সাথে ঠিক নদীর প্রবল স্রোত ও তীর ভাঙ্গা ঢেউ এর মত। হাজারো সুখ– দুঃখের স্মৃতিময় নদী কর্ণফুলীর সাম্পান ও সাম্পান মাঝিদের নিয়ে এমন হাজারো গান ভেসে বেড়ায় চট্টগ্রামের পথে প্রান্তরে।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “কর্ণফুলী” কবিতায় আরাকান রাজ্যের রাজকন্যার সেই করুন স্মৃতিময় ঘটনা, সেই সাথে কর্ণফুলী নদীর অপার সৌন্দর্য্য খুবই চমৎকারভাবে তার কবিতার ছন্দে প্রকাশ করেছেন।
“ওগো ও কর্ণফুলী
তোমার সলিলে পড়েছিল
কবে কার কান ফুল খুলি।
তোমার স্রোতের উজানে ঠেলিয়া
কোন তরী কে জানে
সাম্পান নায়ে ফিরেছিল
তার দায়িতের সন্ধানে
আনমনা তাঁর খুলে গেল খোঁপা
কান–ফুল গেল খুলি
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী
(চক্রবাক গ্রন্থ)
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের ডিসি হিলের ডাক বাংলোতে কর্ণফুলী কবিতাটি লিখেন।
১৯২৫ সালে মতান্তরে ১৯২৬ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবার চট্টগ্রাম আসেন। কবি সে সময় কবির বন্ধু হাবীবুল্লাহ বাহার সহ অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে সদরঘাটস্থ সাম্পান ঘাটে যান। কবি ভ্রমনের উদ্দেশ্যে একটি সাম্পানে উঠেন কিন্তু সে সাম্পানটি ছিল ভাঙ্গা। কবি, বন্ধু–বান্ধবসহ সেই সাম্পানে উঠার কারনে সাম্পানটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অগত্যা কবি অন্য বন্ধুদের সাম্পান থেকে নামার অনুরোধ করে একাই নদী ভ্রমণ করতে যান। এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই কবি তাঁর নিম্মোক্ত বিখ্যাত গানটি রচনা করেছিলেন।
আমার সাম্পান যাত্রী না লয়
ভাঙ্গা আমার তরী
স্বনামধন্য কবি আল মাহমুদ কর্ণফুলীর কথা লিখেছেন তাঁর “পাখির মতো” কবিতায়,
“পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে
বকুল ডাল লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়”
সুকুমার রায় তাঁর “কালুর ঘাটের পুল” ছড়ায় কর্ণফুলীর কথা লিখেছেন চমৎকারভাবে যেমন
“এপার –ওপার যাত্রী নিয়ে
কান–ফাটানো শব্দে ঘটায়
কান্ত হুলস্থুল–
কর্ণফুলীর দু’কুল মিলায়
কালুর ঘাটের পুল”
এই ঐতিহাসিক কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠে বারো আউলিয়ার পূর্ণভূমি আমাদের এই চট্টগ্রাম। তাই এই নদীও চট্টগ্রামবাসীর কাছে একটি পবিত্র নদী।
কবি অজয় দাশগুপ্ত তার
“পবিত্র নদীর নাম” নামক কবিতায় কর্ণফুলী নদীকে পবিত্র নদী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
“দেখে রেখো মনে রেখো তুলে রেখো ভোর থেকে অনন্ত গোধুলী, এ এক পবিত্র নদী
আউলিয়া পদধন্য নাম কর্ণফূলী”
বিশিষ্ট কবি ওহীদুল আলম ১৯৪৬ সালে “কর্ণফুলীর মাঝি” নামক একটি অসাধারন কাহিনী কাব্য রচনা করেছেন।
উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে রচনা করেছেন তাঁর উপন্যাস “কর্ণফুলী”। উপন্যাসটি তিনি রচনা করেছিলেন এই নদীপাড়ের মানুষের জীবন–জীবিকা নিয়ে। উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের জন্য তিনি “ইউনেস্কো” পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বলা বাহুল্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও লোকসংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অপরিসীম।
সেই রূপ নদীর জলে লাফিয়ে পড়া এবং রাজন্যাকে উদ্ধারে ব্যার্থ রাজকুমারের নদীর জলে আত্নাহুতি দেয়ার মত করুন বিয়োগান্ত কাহিনী কম–বেশী সবারই জানা।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের পথিকৃৎ বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার এবং কন্ঠশিল্পী মলয় ঘোষ দস্তিদার এর কালজীয় গান এই কর্ণফুলীকে শ্রেষ্ঠ করেছে “ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানিত” লুসাই ফাহাড়ত্তুন নামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী”
অর্থ– ছোট ছোট ঢেউ তুলে লুসাই পাহাড় থেকে নেমে কর্ণফুলী
নদী বয়ে চলেছে।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত উপরোক্ত গানটিতে কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তিস্থল “লুসাই” নামক পাহাড়ের কথা উল্লেখ আছে।
মলয় ঘোষ দস্তিদারের “ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানিত” গানটিতে আরো উল্লেখ আছে কর্ণফুলী নদীর কিংবদন্তীর কথা
যেমন
“পাহাড়ী কন সোন্দরী মাইয়া ঢেউয়ের পানিতে যায়
সেয়ান গরি উডি দেখে কন্যা কানত ফুল তার নাই”
“ফাহাড়ী (পাহাড়ী) হন(কোন) সুন্দরী মাইয়া ঢেউয়ের ফানিত (পানিতে যায়) সেয়ান (স্নান) গরি (করে) দেহের (দেখে) হইন্যা (কন্যা) হানর (কানের) ফুল তার নাই।
যেদিন হানর (কানর) ফুল হারাইয়ে (হারিয়েছে) সেদিনত্তুন (সেদিন থেকে) নাম কর্ণফুলী”
প্রায় একই রকম কিংবাদন্তী আরো রয়েছে এর নামকরনের পেছনে।
কর্ণফুলী নদীর এই কিংবদন্তীকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের উদ্যোগে, নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক শিল্পী অরুপ বড়ুয়ার পরিচালনায় ২০১৮ সালের ১৫ইং মে চট্টগ্রামের আলিয়স ফ্রসেজে “কর্ণফুলী– দুলি –দুলি” শিরোনামে একটি পুতুল নাচ/ পাপেট শো মঞ্চস্থ হয়। ঠিক পরের বছরই শোটি পুনরায় ঢাকাস্থ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে মঞ্চস্থ হয়।
এই পাপেট শো–তে আমরা দেখি আদিবাসী রাজপুত্র ও রাজকন্যার প্রথম দেখা, প্রেমে পড়া, রাজকুমার কর্তৃক রাজকন্যাকে দূর্গম পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে আনা দুর্লভ ফুল উপহার দেয়া এবং অসামান্য ফুলটি হঠাৎ নদীর পানিতে পড়ে যাওয়া এবং সবশেষে ফুলটি উদ্ধার করতে গিয়ে রাজকুমার ও রাজকন্যার শোচনীয় মৃত্যুর দৃশ্য।
এই শো–তে শিল্পী অরূপ বড়ুয়া প্রচলিত কিংবদন্তীর সাতে মিল রেখে মূল ঘটনার সাথে নিজস্ব চিন্তা–ভাবনা ও সৃজনশীলতা চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত বিভিন্ন গান– নাচ, গানের সাথে নাচ এবং শুদ্ধ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও আদিবাসী ভাষার সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব, মনোজ্ঞ ও দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনার অবতারনা করেছেন।
কর্ণফুলীকে নিয়ে শিল্পী মলয় ঘোষ দস্তিদারের অন্য গান যেমন ঃ
“চাটগাাঁইয়া নওযোয়ান আরা চাটগাঁ আঁরার জান
কর্ণফুলীর পানিত অভাই জুড়াই যে পরান”
বা
“বাহার মারি সাম্পান যার
দাড় দুইয়ানে কেক্রোত গরে
দৈজ্যা হয় তোলপাড়” ইত্যাদি।
বিশিষ্ট কবি ও শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ তার “কর্ণফুলীর নিজের কথা” কবিতায় লিখেছেন।
“নেই রাত দিন, মানি নি রুটিন
চলেছি সমানে বয়ে
মিশে গেছি ওই সাগরের সাথে
কালের সাক্ষী হয়ে
নীরবে– নিবিড়ে আছি
বেশি দূরে নয়
তোমাদের সাথে তোমাদের কাছাকাছি।
চট্টগ্রামের কবি আবুল কালাম বেলাল এর ভাষায় :
“একটি নদী লুসাই থেকে
নামছে অবিরাম
চলছে খুঁজে দূর সাগরে
মায়ার মায়াধাম” (কবিতা একটি নদীর জীবন ছবি)
কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তিস্থল “লুসাই” পাহাড় এর কথা আরো উল্লেখ আছে এমন বিভিন্ন গান, কবিতা ও ছড়ায়।
প্রেম ও বিরহ সম্পর্কিত চট্টগ্রামে যে সকল গান প্রচলিত আছে তাতে কর্ণফুলী নদী অনুসঙ্গ হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে।
যেমন বিশিষ্ট কন্ঠশিল্পী, গীতিকার সনজিত আচার্য্যের নিম্মোক্ত গান সবার মন কেড়েছে
ওরে কর্ণফুলী রে
সাক্ষী রাখিলাম তোরে
অভাগিনীর দুঃখের হতা (কথা)
হবি (বলবি) বন্ধুরে—-
প্রবাসী স্বামীর বিরহে কাতর চট্টগ্রামের কোন এক রমনীর বিলাপ এ গানের প্রতিপাদ্য বিষয়।
বর্তমানে চট্টগ্রামবাসীর এই সাধের কর্ণফুলীর অবস্থা ভালো যাচ্ছেনা। অনাদর– অবহেলা, দখল–দূষণে জর্জরিত এই নদী।
শিল্প কলখারখানা ও বিষাক্ত মানব বর্জ্য, নালা নর্দমা, খালের বিষাক্ত জল, জলযান ও জাহাজের চিমনি–নির্গত কালো ধোয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের নির্মল পরিবেশ। যথেচ্ছ বননিধন এর কারনে বাড়ছে ভূমিক্ষয়। অবাধে বৃক্ষ নিধন আর পাহাড় কাটার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা ও জনবসতি বাড়ার ফলে পরিবেশ দূষণের সাথে সাথে বাড়ছে নদী দূষণ। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে কর্ণফুলীর বয়ে চলার ছন্দে। মানবিকতা, শৈল্পিকতা ও রোমান্টিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে করে প্রকৃতির কোলে লালিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সহজ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ঘটে গেছে ছন্দপতন।
কবি আল মাহমুদ এর ভাষায়
“চাকমা মেয়ে রাকমা
ফুল গোজে না কেঁশে
কাপ্তাইয়ের ঝিলের জলে
জুম গিয়েছে ভেসে”
উপরোক্ত কবিতায় আরো উঠে এসেছে কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই এলাকায় বসবাসরত আদিবাসীদের দু:খ কাপ্তাই বাঁধের কথা।
কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মানের ফলে ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত হয়। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে কাপ্তাই এলাকার স্থায়ী অধীবাসিরা তাদের বাড়ী–ঘর এবং চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়েছেন। এছাড়াও ব্যাপকভাবে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জীববৈচিত্র বন্যপ্রাণী এবং তাদের বসবাস উপযোগী আবাস।
কিশোর কবিতার কবি অরুণ শীল তার “আঁকতে গিয়ে” কবিতায় কর্ণফুলীর ব্যাথা এই বাঁধকে ভাঙ্গার জন্য যে আকুল আর্তি জনিয়েছেন, তা আমাদের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি লিখেছেন–
“কর্ণফুলী বললো
কষ্ট করুন মুখে
আমার বুকে বাঁধটি রেখে
আঁকছে ছবি সুখে
ডুবছে দেখো পাহাড় টিলা
চাকমা রাজার ঘর
বুকের উপর থেকে সরাও
শোকের এই পাথর।”
বিষাক্ত বর্জ্য ও ধোঁয়া যখন আমাদেরকে গ্রাস করতে থাকে, যখন দম বন্ধ হয়ে আসে, তখন মন হাফিয়ে ওঠে, কেবল মনে পড়ে চোখে ভাষা সেই মায়াবিনী শান্ত, স্নিগ্ধ নদীটির নির্মল ছবি।
আজ বড়ই অভাব সেই সকল গান, কবিতা ও কাহিনীর যা রচিত হয়েছিল হাজার বছরের বয়ে চলা ইতিহােেসর অমর সাক্ষী এই কর্ণফুলীকে নিয়ে।
তাই আসুন আমরা সকলেই এই প্রার্থনা করি– সকল কলুষতা, মলিনতা, আগ্রাসন, দুর্নীতি, আবর্জনা, দূর হয়ে যাক কর্ণফুলী তোমার প্রবল তীক্ষ্ম স্রোতধারায়।
তথ্যপঞ্জি :
১. প্রেমে বিচ্ছেদে সংগ্রামে: পূন্যভুমি চট্টগ্রাম– ইকবাল হায়দার, প্রকাশ ২জুন ২০১৭ সাহিত্য সপ্তাহিকী, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম, ২. আমার রচিত গান যত–ইকবাল হায়দার, রচনাকাল– মার্চ ২০১৯, প্রকাশক– কালধারা প্রকাশনী। ৩. ছড়া ও কবিতায় কর্ণফুলী–সম্পাদক– আবুল কালাম বেলাল , প্রকাশক–শৈলী প্রকাশন–২০১৬, চট্টগ্রাম। ৪. চক্রবাক: কাজী নজরুল ইসলাম, কবিতা: কর্ণফূলী। ৫. কবি আল মাহামুদের কবিতা। ৬ সুকুমার রায় ছড়া– ‘কালুর ঘাটের ফুল’ ৭. বিশিষ্ট কবি ওহীদুল আলমের কাহিনী কাব্য‘কর্ণফূলীর মাঝি’ প্রকাশকাল–১৯৪৬ ইং। ৮. শিল্পী অরূপ বড়ুয়ার পাপেট শো: কর্ণফূলী দুলি দুলি–২০১৮। ৯. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, শিল্পী রাসেল কান্তি দাশ এর জলরঙে আঁকা দুইটি চিত্র।
সমাপ্ত