পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, সরকার আবাসিক খাত এবং সার ও চা শিল্প ছাড়া অন্য সব খাতে গ্যাসের দাম ১৪ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, এটা কার্যকর হবে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে। নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টের গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে ৮৮ শতাংশ বেড়ে ৩০ টাকা হবে। বড় শিল্পের ক্ষেত্রে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে ১৫০ শতাংশ বেড়ে ৩০ টাকা হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্পখাতের বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ব্যয় বাড়ার এই ভার বহনের সক্ষমতা নেই।
গতকাল সকালে নগরীর খুলশীতে বিজিএমইএ ভবনের মাহবুব আলী হলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির কারণে কারখানা পরিচালন ব্যয় এখন অনেক বেশি বেড়ে যাবে। মনে করেন, কোনো কারখানার গ্যাসের বিল যদি হয় ২০ লাখ টাকা, এখন সেখানে ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া শ্রমিকের বেতন ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপসহ অন্যান্য বিষয় তো থাকছেই।
এসব সংকটের মধ্যেও ২০২২ সালে বাংলাদেশ পোশাক শিল্প রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। গত বছর বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ৪৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানির নতুন রেকর্ড গড়েছে। ২০২১ সালের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর পেছনের কারণ হলো কাঁচামালের বাড়তি দামের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পণ্যের এই মূল্য বৃদ্ধির সুফল উদ্যোক্তারা নিতে পারছেন না। অন্যদিকে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সবুজ শিল্পায়নে বিপুল বিনিয়োগ করলেও তারা তার যথাযথ মূল্য দিচ্ছেন না।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ আজ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন প্রথম অবস্থানে। সরকারের নীতিগত সহযোগিতায় ইউরোপের বাজারে আমরা অতি শিগগিরই এক নম্বর অবস্থান নিতে সমর্থ হবে। অন্যদিকে চীন থেকে গত কয়েক বছরে অনেক ক্রয় আদেশ বাংলাদেশে এসেছে। আগামী আট বছরে এর পরিমাণে আরও বাড়বে। চীন যেহেতু পরিবেশগত কারণে টেঙটাইল থেকে সরে আসছে, ফলে সঙ্গত কারণেই সেগুলো বাংলাদেশে আসবে বলে আমরা ধারণা করছি। আমরা এই সুযোগগুলো গ্রহণ করতে চাই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী এক–দুই দশকে এক ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে আমাদের দেশ। গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি যদি ৫ শতাংশেও নামে, তাতেও ২০৪০ সালের মধ্যেই এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছানো সম্ভব। আর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হলে ২০৩০ সালেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব।
ফারুক হাসান বলেন, বিশ্বজুড়ে চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুতের অপ্রতুলতার কারণে কারখানাগুলোতে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালানো হচ্ছে। এতে করে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ক্রমবর্ধমানভাবে কমছে। এছাড়া সমপ্রতি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের মূল্য ২০২২ সালের তুলনায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের প্রতি আমাদের একান্ত অনুরোধ, খাত ভিত্তিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের অবদানের কথা বিবেচনা করে এ খাতকে আরও গুরুত্ব দেওয়া। এছাড়া গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে আমদানির ওপর ভ্যাট ও ট্যাঙ প্রত্যাহার করার জন্য আমি বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা গ্যাস সঞ্চালনে সিস্টেম লস কমিয়ে আনুন, অবৈধ সংযোগগুলো বন্ধ করে দিয়ে গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করুন। শিল্পের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করুন। সেই সঙ্গে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করুন।
তিনি আরো বলেন, পতেঙ্গা উপকূলে প্রস্তাবিত বে–টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল সম্ভব হবে। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে, ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থ নিতে পারবে। বে–টার্মিনালের চূড়ান্ত কাজ সম্পাদন হলে প্রায় ১৫টি জাহাজ একসঙ্গে বার্থ নিতে পারবে। এতে আমদানি–রপ্তানিতে সময় এবং খরচ অনেকাংশে কমবে এবং রপ্তানি বাণিজ্যের সক্ষমতা বাড়বে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে বড় বড় জাহাজের মাধ্যমে সরাসরি আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। এক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরসমূহের ব্যবহার অনেকাংশে কমবে। এতে করে পোশাক শিল্পে লিড টাইম কমবে, খরচ সাশ্রয় হবে।
পোশাক শিল্পে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে বিজিএমইএ নারী কর্মীদর উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করছে জানিয়ে হাসান ফারুক বলেন, চট্টগ্রামে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি চালু করেছি। চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যানে ৫০০ নারী কর্মীকে আমরা পড়াবো। দক্ষতা অর্জন করে তারা এ শিল্পকে সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর প্রথম সহ–সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সহ–সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, রাকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক আসিফ আশরাফ, মো. মহিউদ্দিন রুবেল, মো. হাসান জ্যাকি, এম এহসানুল হক, সাবেক প্রথম সহ–সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সহ–সভাপতি মোহাম্মদ নাসির, এএম চৌধুরী সেলিম, সাবেক পরিচালক আ ন ম সাইফুদ্দিন, মোহাম্মদ মুসা, অঞ্জন শেখর দাশ, আবদুল ওহাব প্রমুখ।












