প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, ভাষা সৈনিক, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত, মুদ্রাবিশারদ, লেখক এমন আরো অনেক গুণের অধিকারী আমার বাবা মুর্তজা বশীরের জীবন যাপন ছিল একেবারে সাধারণ, আটপৌরে। খুব সাধারণ ভাবে চলতেন তবে ছিলেন আপাদমস্তক ফ্যাশন সচেতন। যখন যা ফ্যাশনের চল এসেছে, মোটামুটি ভাবে সেটা অনুসরণ করেছেন। ৫০-৬০ দশকে স্লিম ফিট শার্ট, চিপা প্যান্ট, ৭০ এর দশকে রঙ চঙে শার্ট, জিন্স, বেলবটম প্যান্ট, বাবরী চুল, চওড়া বেল্ট…. সবই পরেছেন তিনি সময়ে সময়ে। পোশাক নিয়ে তাঁর রুচিবোধ সবাইকে বিস্মিত করতো। এমনকি মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পোশাকের ব্যাপারে তিনি রুচিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।
রঙিন পোশাক তাঁর পছন্দ ছিল। কেউ কখনও ফ্যাকাশে রঙের কোনো শার্ট বা পাঞ্জাবী দিলে তিনি বলতেন, তোমরা তো আমাকে বুড়া বানিয়ে দিচ্ছো।
তাঁর লুঙ্গী প্রীতি ছিল। একবার আম্মা আর আব্বু মিমি সুপার মার্কেটে যাবেন, আম্মা তৈরি হয়ে দেখলো আব্বু লুঙ্গী আর ফতুয়া পরে রেডি। আম্মা তো অবাক! বললেন, তুমি কি লুঙ্গি পরে যাবে? আব্বু ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলেন, কেন? অসুবিধা কী? লুঙ্গি তো আমাদের জাতীয় পোশাক। শ্রীলঙ্কা, নেপালীরা পরে না? আম্মা তো কিছুতেই যাবে না, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত আব্বুর জেদের কাছে হেরে যায়।
আমি যখনই দেশের বাইরে ব্যাংকক, মালয়েশিয়া কিংবা ইন্ডিয়াতে গিয়েছি আব্বু আমাকে লুঙ্গি আনতে বলতেন। ঐ সব দেশের লুঙ্গি খুব কালারফুল হয়। আব্বু খুব পছন্দ করতেন। অনেক সময় দরজীকে ডিজাইন দিয়ে দিতেন লুঙ্গীর কাপড় কেটে শার্ট বানানোর জন্য। আমাদের পোশাকের ডিজাইনও আব্বু করতেন।
আব্বুর বাচনভঙ্গি, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, কেতাদুরস্ত পোশাক আশাক, হাতে পাইপ, চুরুট কিংবা সিগারেট সবাইকে আকৃষ্ট করতো, যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি হয়ে উঠতেন মধ্যমণি।
২০১৩ সালে লাংস ইনফেকশনে আংক্রান্ত হয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি চলে গিয়েছিলেন আব্বু। কিন্তু, প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী আব্বু আল্লাহর অশেষ রহমতে আবার ফেরত আসেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে পোর্টেবল অক্সিজেন নিয়ে চলাচল করতে হয়েছে। ৮৮ বছর বয়সেও তাঁর ছিল চিরযুবা মন। ২০১৭ সালের ১৩ মে আম্মা মারা যাবার পর আব্বু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
২০২০ সালের ১৫ অগাস্ট করোনা মহামারিতে আব্বু চলে গেলেন অনন্তকালের পথে। আমার এখনও মনে হয়, এটা একটা দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলে আবার সব আগের মত হয়ে যাবে। আব্বু বলবে, ‘কিরে, কয়দিনের সফরে আসলি’?
লেখক : ব্যাংকার ও শিল্পী তনয়া