শিল্পীদের সহায়তায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ফান্ড করার পরামর্শ মেয়রের

উস্তাদ মিহির লালা নাগরিক স্মরণসভা । এ জনপদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে গেছেন মিহির লালা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ at ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশীয় সংগীতে কেউ মহান শিল্পী, কেউ হয়তো হয়েছেন সঙ্গীতজ্ঞ। এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম উস্তাদ মিহির লালা। তিনি সারা দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী এবং যথার্থ সঙ্গীতজ্ঞও। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল প্রলোভনের যুগে চটুল লঘু বিনোদনমুখী গানবাজনার সংসর্গ থেকে দূরে সরে থেকে নিজেকে তিনি ব্যাপৃত রেখেছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের কলাক্ষেত্রে। একইসঙ্গে শুদ্ধ সুরের বীজতলা তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কঠিন পথের অনুগামী করে তিনি যথার্থই সংগীত গুরু ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে সারা দেশে নিজেকে পরিগণিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক ও শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী প্রয়াত ‘উস্তাদ মিহির লালা নাগরিক স্মরণসভা ও স্মরণ্যের মোড়ক উন্মোচন’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বক্তারা।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। উস্তাদ ‘মিহির লালা নাগরিক স্মরণানুষ্ঠান পর্ষদ’ এর উদ্যোগে আয়োজিত এ স্মরণসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রধান আলোচক ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। উদ্বোধক ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত অসিত কুমার দে। আলোচক ছিলেন বরেণ্য বংশীশিল্পী উস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ রীতা দত্ত। সভাপতিত্ব করেন উস্তাদ মিহির লালা নাগরিক স্মরণানুষ্ঠান পর্ষদের আহ্বায়ক দীপেন চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্মরণানুষ্ঠান পর্ষদের সমন্বয়ক মুক্তা বিশ্বাস সঙ্গীতা। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করেন টিউনারি মিউজিক্যাল শপ।

মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন শিল্পীদের চিকিৎসা ব্যয়সহ অন্যান্য আর্থিক সংকট দূরীকরণে একটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ফান্ড করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিল্পীদের শেষ অবস্থাটা করুণ থাকে কেন আমি বুঝি না। তাদের অনেকেই টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারে না। এ বিষয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। কাজেই আমার মনে হয়, আপনারা (শিল্পীরা) একটা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। যেখান থেকে সঙ্গীত শিল্পীদের চিকিৎসা সহায়তা করতে পারবেন। এ ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে। ট্রাস্টি বোর্ড করে ফান্ড গড়ে তুলেন। কেবল চিকিৎসা সহায়তা নয়, কোনো শিল্পী টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে না পারলেও এ ফান্ড থেকে সহায়তা করতে পারবেন। ডা. শাহাদাত বলেন, বাংলাদেশের নামকরা নায়িকা ছিলেন সঙ্গীতা দেবী। উনার শেষ অবস্থায় চিকিৎসা করার টাকা ছিল না। আমি দেখেছি, চট্টগ্রামে একটা ফান্ড করা হয়েছিল উনার জন্য। আরো অনেকের ক্ষেত্রে এটা দেখেছি। কাজেই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকায় ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে ফান্ড তৈরির বিষয়টি বলছি।

মেয়র বলেন, উস্তাদ মিহির লালা ছিলেন একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ ও দেশবরেণ্য উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তার মৃত্যু চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে একটি নক্ষত্রের পতন হলো। চট্টগ্রামবাসী হারালো এক মহান সঙ্গীতগুণীকে। তবে তিনি তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, জ্বল জ্বল করবেন সঙ্গীতের আকাশে।

আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘যেখানে শব্দের সীমা শেষ হয়ে যায়, সেখানে সঙ্গীত বা সুর কথা বলে’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, যখন সুর উঠে আসে হৃদয়ের গভীর থেকে তখন তা হয়ে উঠে আত্মার ভাষা। উস্তাদ মিহির লালা সেই সুরের মানুষ। তিনি ছিলেন এমন একজন সাধক, যিনি সঙ্গীতকে আত্মার ভাষায় রূপ দিয়েছিলেন। যেখানে অন্যরা শব্দ সাজিয়ে কথা বলেন, তিনি সুরে বলতেন। উস্তাদ মিহির লালা বেঁচে থাকবেনতার শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে, তার শেখানো সুরে। আমাদের হৃদয়ে।

এম এ মালেক বলেন, চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে। যুগে যুগে বহু মানুষ সেই ঐতিহ্যকে, সেই সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছেন। উস্তাদ মিহির লালা এমনই একজন মানুষ শাস্ত্রীয় বা ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারাটিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কালজয়ী অবদান রেখে গেছেন। তিনি তৈরি করেছেন শত শত সঙ্গীতপ্রেমী। গড়েছিলেন একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলযেখানে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে যখনই কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন সঙ্গীত চর্চার জন্য এগিয়ে এসেছে, উস্তাদ মিহির লালা তাদের সাহচর্য দিয়েছেন, সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, আমি গান শেখাই না, গানকে ভালবাসতে শেখাই।

দেশের প্রবীণ এ সম্পাদক বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে সবসময় তুলে ধরতে চায় আজাদী। এ অঞ্চলের মানুষের সাফল্যের কথা আমরা নিজের গৌরব হিসাবে প্রচার করি। আজাদী সম্পাদক হিসাবে আমি এখানেও একটা ব্যাপারে গৌরব বোধ করতে পারি আমাদের পত্রিকায় তাকে (উস্তাদ মিহির লালা) নিয়ে আমরা অসংখ্য লেখা ছাপিয়েছি। তার কীর্তি আমরা তুলে ধরেছি। এই অঞ্চলের প্রতিভা, সাংস্কৃতিক শক্তিকে সবসময় তুলে ধরার, তাদের পাশে থাকার আমাদের ভূমিকা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

পণ্ডিত অসিত কুমার দে বলেন, সংস্কৃতি ও সংগীতজগতে যে কজন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাদের মধ্যে মিহির লালা অন্যতম। তার জীবন যেন এক নিরবচ্ছিন্ন সুরের ধারা, যেখানে সংগীত শুধু সাধনার বিষয় নয়, বরং জীবনের পথচলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেন, মিহির লালার জীবন থেকে আমরা শিখি, সংগীত কেবল বিনোদন নয়, এটি আত্মার খোরাক, সংস্কৃতির ধারক এবং জাতির ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। মিহির লালা কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষ তাকে যেমন আপন করে নিয়েছে, তেমনই তিনি সংগীতের মাধ্যমে এই জনপদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি তার গভীর অনুরাগ, শ্রদ্ধা ও একনিষ্ঠতা তাকে গড়ে তুলেছিল এক স্বতন্ত্র শিল্পীসত্তায়। লোকসংগীত, শাস্ত্রীয় সংগীত, দেশাত্মবোধক গানসব ক্ষেত্রেই তাঁর অনবদ্য অবদান প্রশংসার দাবিদার।

উস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম বলেন, মিহির লালা চট্টগ্রামের সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। সদা হাস্যমুখ ছিলেন। ছিলেন অসাধারণ গুণীজন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি নজরুল সঙ্গীতেও সমান পারদর্শী ছিলেন। একজন ভাল শিক্ষক ছিলেন। নজরুল সঙ্গীত এবং সাস্ত্রীয় সঙ্গীত দুটোই ভাল শেখাতেন। স্রষ্টা তাকে অনেক গুণ দিয়েছেন। মিহির লালা অনেক ছাত্রছাত্রী রেখে গেছেন; এদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত। এটাই ওনার (মিহির লালা) স্বার্থকতা। এই ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে মিহির লালা বেঁচে থাকবেন।

অধ্যক্ষ রীতা দত্ত বলেন, সবাই জানেন মিহির লালা শুধু সুরের সাধন করেছেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের বিরল সুযোগ পেয়েও তিনি মগ্ন হলেন সুরসাধনায়। হয়ে গেলেন একজন সুর সাধক। পার্থিব জগতের অর্থবিত্ত তাকে আকর্ষণ করেনি। শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশাল সাগরে অবগাহন করে তিনি আয়ত্ত করেছেন অসংখ্য রাগরাগিনী। একনিষ্ঠ আন্তরিকতায় তিনি ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন অবলীলায়। তার ছিল না কোনো সাম্প্রদায়িক ভাবনা। যে কোনো সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা তার আন্তরিক সাহচর্য পেয়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতে প্রথিতযশা শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন। তার এই প্রয়াণে ছাত্রছাত্রীরা হারিয়েছে একজন মহান অভিভাবক এবং শাস্ত্রীয় সংগীত জগতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তিনি চির অম্লান হয়ে থাকবেন তার অগণিত ছাত্রছাত্রীর অন্তরে এবং স্বজনদের শ্রদ্ধায় স্মরণে।

দীপেন চৌধুরী বলেন, উস্তাদ মিহির লাল আজ আমাদের মাঝে নেই। শিক্ষার্থী অন্তঃপ্রাণ উস্তাদ মিহির লালা রেখে গেছেন, মেধা ও মননের গৌরবময় উত্তরাধিকার তার অগণন শিক্ষার্থী। তাদের অসামান্য গুরুভক্তি। শিক্ষার্থীরা গুরুর স্বপ্নের প্রতিমূর্তি। শিক্ষার্থীদের হাতে একদিন সৃজিত হবে নূতন মননের স্বপ্নসৌধ। তার রাজকীয় জীবনাচরণ ও গায়নশৈলির স্বাতন্ত্র্য তাকে হারানোর বেদনার সাথে বারবার উচ্চারিত হবে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তার প্রতি অতলান্ত শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিলল রেকর্ড ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬