শিরায় শিরায় আজাদী : রাঙা শৈশব

ফারহানা ইসলাম রুহী | সোমবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিদিন সকালে দরজার নিচে একটি শব্দহীন শব্দ এসে পড়তটুক! সেই শব্দে জেগে উঠত আমাদের ছোট্ট পৃথিবী। একটা খবরের কাগজ। তার নামআজাদী। আজাদী মানে কেবল ছাপার অক্ষর নয়, আজাদী মানে ছিল আমাদের ঘুমভাঙা ভোর, বাবার হাতে কাগজ তুলে দেওয়া, ভাইবোনের খুনসুটিকে আগে পড়বে পেপার! আর ছিল মায়ামাখা সেই কাগজের গন্ধ, যা আজও বুকের গভীরে এক ধূপকাঠির মতো জ্বলতে থাকে। আমার লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল সেই পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে। গোলাপি পাড়ের শাড়ি পরা মায়ের কোলে বসে আমি পড়তে শিখছিলাম প্রথম শব্দ, আর সঙ্গে সঙ্গে শিখছিলাম ভালোবাসতেভাষা, সমাজ, দেশ আর সত্যকে। আজাদী হয়ে উঠেছিল প্রতিদিনকার পাঠশালা, যেখানে আমরা শিখেছি ভাবতে, জানতে, প্রতিবাদ করতে।

আজাদী শুধু একটি সংবাদপত্র নয়, এটি ছিল এক জীবন্ত বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে প্রতিটি লেখা একেকটি পাঠ, প্রতিটি কলাম একেকটি প্রশ্ন। এই পত্রিকার পাতায় কত শত স্বর উঠে এসেছেযুদ্ধের স্মৃতি, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ, সমাজের সত্য, আর সাহিত্যের সুবাস। চট্টগ্রামের আত্মা যদি কেউ জানতে চায়, তাকে আমি আজাদীর পাতায় পাঠাতে চাই। যে শহর একদিকে বন্দর, একদিকে পাহাড়, আরেকদিকে সাহিত্যের গীতধ্বনিসেই শহরের ভাষ্যকার আজাদী। ষাটের দশকে যখন চারদিকে স্তব্ধতা, তখন আজাদী শব্দ তুলেছিল, সাহস দেখিয়েছিল, সত্য বলেছিলআর সেই সত্যের মূল্য দিতে হয়েছিল বিজ্ঞাপন হারিয়ে, চাপ সহ্য করে, তবুও নিজেদের বিবেককে বিক্রি না করে। আজাদী তাই শুধু সংবাদ ছাপেনি, গড়ে তুলেছে এক প্রজন্মের চিন্তা ও চেতনাকে।

আজাদীর সাহিত্যিক ভূমিকাও বিস্ময়কর। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের উষ্ণ আলোয় ছাপা হতো ‘পূরবী’ সাহিত্য সংকলন, যেখানে অন্নদাশঙ্কর রায়, আশুতোষ চৌধুরী, . মুহাম্মদ এনামুল হকের মতো মনীষীদের লেখা স্থান পেত। একটি পত্রিকার পৃষ্ঠায় কত শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ, আর মননের চিহ্নএই উপলব্ধি আজও আলো দেয় মনে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আজাদীকে যে পদকে ভূষিত করে, তা শুধু একটি সম্মাননা নয়, বরং চট্টগ্রামের মানুষদের তরফ থেকে এক কৃতজ্ঞতা স্বীকৃতি। আজাদী একদিকে যেমন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগায়, অন্যদিকে হাজারো মানুষের জীবিকার হাতছানি। একজন কবির প্রথম প্রকাশ যেমন এখানে হয়, তেমনি একজন হকারের প্রথম উপার্জনের গল্পও আজাদীর সঙ্গে জড়িয়ে।

আজ আমি কৃতজ্ঞ সেই আজাদীর প্রতিযিনি আমার লেখকসত্তাকে প্রথম পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন। আজ আমি ভালোবাসা জানাই সেই পরিবারকে, যারা যুগের পর যুগ এই ধ্যানমগ্ন বৃক্ষটি বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর ভালোবাসা রইল সেই সমস্ত পাঠক, লেখক, সম্পাদক, হকার, মুদ্রাকরযাঁরা মিলে গড়ে তুলেছেন আজাদীর মতো এক বিস্ময়। দৈনিক আজাদী আজ শুধু সংবাদপত্র নয়, এটি চট্টগ্রামের আয়না। আজাদী বেঁচে থাকুক আরও বহু বছরচট্টগ্রামের হাওয়ায়, সাহিত্যে, মানুষের জীবনের স্পন্দনে এবং সত্যের দীপ্ত মানসে।

লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষক, সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষকদের অবসর হোক সুখময়
পরবর্তী নিবন্ধআজাদীর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা