শিবনারায়ণ রায় এক নক্ষত্র

জ্যোতির্ময় ধর | রবিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্যে মনস্বী প্রাবন্ধিক ও তত্ত্বচিন্তক শিবনারায়ণ রায় এক নাক্ষত্রিক ব্যক্তিত্ব। মানবতন্ত্রের মূল প্রত্যয় তিনি বিশ্বনাগরিক, বিবেকী ভাবুক, দায়িত্বশীল চিন্তক, শিক্ষাবিদ, মৌলিক মানবতাবাদী, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক তথা বিশিষ্ট সম্পাদক শিবনারায়ণ রায়। তিনি সর্বদা, সর্বত্রই নাস্তিক্য, যুক্তিবাদ ও বুদ্ধির মুক্তি ও মানবতাবাদের পক্ষে সক্রিয় থেকেছেন। সে জন্যই বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল একদা শিবনারায়ণ রায়ের উপর মন্তব্য করে বলেছিলেন ‘শিবনারায়ণ রায় দাঁড়িয়েছেন সেই মতের পক্ষে যেটাকে আমি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তাঁর লেখা আমাদের সময়ের অধিকাংশ লেখকের চেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে প্রকাশিত’।

তাঁর লেখা ৫০টিরও বেশি গ্রন্থ, যেমন সাহিত্য চিন্তা ১৯৫৬, নায়কের মৃত্যু ১৯৬০, মৌমাছিতন্ত্র ১৯৬০, কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা ১৯৭৩, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি ও অবক্ষয় ১৯৮১, রবীন্দ্রনাথ শেক্সপিয়র ও নক্ষত্র সংকেত ১৯৮৩, স্রোতের বিরুদ্ধে ১৯৮৪, রেনেসাঁস ১৯৯২, স্বদেশ, সকাল স্বজন ১৯৯৬, যে আলোকে অনেক আঁধার ১৯৯৮, প্রত্যয়, অন্বেষা ও অনুচিন্তন ২০০১, খাড়াইয়ের দিকে ২০০২, বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা ২০০৩, জিজ্ঞাসার দশ দিগন্ত ২০০৪, লাঠি থেকে লাটাই ২০০৫, এবং কাব্যগ্রন্থ খোয়াব দেখি সত্তরে, মাইকেল! মাইকেল, কথারা তোমার মন ইত্যাদি গ্রন্থের বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধগুলিতে তথ্য এবং গুটিকয়েক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তাঁর মনীষার প্রগাঢ় প্রদীপ্তি, নতুন ভাবনা, চিন্তনের অকুণ্ঠ জিজ্ঞাসা সুপ্ত ভঙ্গিমায় দীপিত হয়েছে।

সেই প্রদীপনে এবং বিশ্বমনীষার মানচিত্রে সেকালের পাশ্চাত্যের হোমার, দান্তে, শেঙপিয়রগ্যাটে, ব্লেকমিল্টন প্রমুখের সৃষ্টি জগত যেমন বাদ পড়ে নি তেমনিই বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যের মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল এবং তাঁর সমকালের জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখ মনীষার সৃষ্টির ঐশ্বর্য ও দর্শন, তাঁর যুক্তি ও মননের নতুন ভাষা ও ভাবনায় বাঙালি পাঠককুলকে নতুন পাঠবীক্ষায় উন্নীত ও দীক্ষিত করতেও সচেষ্ট থেকেছে সর্বদা।

মনে, প্রাণে, ধ্যানধারনায় শিবনারায়ণ রায় কিন্তু রেনেসাঁসের প্রতীক পুরুষ।

তাঁর রেনেসাঁস সম্পর্কিত গ্রন্থাদিতে পাশ্চাত্যের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রাসেল এবং প্রাচ্যদেশীয় রামমোহন, ডিরোজিও, অক্ষয়কুমার দত্ত, মানবেন্দ্র রায় প্রমুখের জীবন জিজ্ঞাসাকে তিনি তাঁর রেনেসাঁস সংক্রান্ত লেখার বিষয় করে সমাজ পরিবর্তনের যুক্তিসম্মত পথ ও পাথেয় এষণায় ব্যাপৃত থেকেছেন।

শিবনারায়ণ রায়ের দর্শন ও রাজনীতি চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ‘মৌমাছিতন্ত্র’ কেই মনে করেন অনেকে। মৌমাছিতন্ত্র মূলত কমিউনিজমকে সমালোচনা করে লেখা। শিবনারায়ণ মনে করতেন ব্যক্তিসত্তার বিলোপ এবং রাষ্ট্রের প্রতি কঠোর আনুগত্য একদিন পৃথিবীতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই গ্রন্থ তিনি লিখেছিলেন ষাটের দশকে, যখন পৃথিবী ব্যাপী চলছে কমিউনিজমের জয় জয়কার। তাঁর অভিমত ছিল যে রাষ্ট্র থেকে প্রেম ও সৃষ্টি নির্বাসিত, সেখানে স্বাধীন চিন্তা নিষিদ্ধ। সেখানে বৈচিত্র্য অবলুপ্ত। সেখানে স্বাতন্ত্র্যের শাস্তি দাসত্ব অথবা মৃত্যু।

গণতন্ত্র ও সংস্কৃতি এবং চার্চ’ প্রবন্ধে শিবনারায়ণ রায় দেখিয়েছেন গণতন্ত্রের ভিত্তিমূল কোনও দল বা দলের ক্ষমতা বা পাশ্চাত্যের চার্চ বা প্রাচ্যের কোনো মন্দিরের আধিপত্য বা শাস্ত্রীয় বিধিবিধান নয়। গণতন্ত্রের ভিত্তি হল ব্যক্তিমানুষ, তার স্বাধীনতা বা স্বাধিকার বোধ। যে বোধ গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পথ ধরে, সংস্কৃতির মুক্ত আবহাওয়ায়, নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা ও চিন্তাচেতনার ঘাতপ্রতিঘাত ও অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তি তার অন্তর্নিহিত সৃজনের বিচিত্র সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পথ ধরে নিজের যে জাগরণ ঘটায়, নিজের বিশ্বাস ও অন্তরের শক্তিকে প্রকাশ করে যে জাগরণে, যে প্রকাশে কোনও শক্তির আনুগত্য নেই, কোনও পদানতি নেই। সেখানেই রেনেসাঁসের বীজ সেই পথই রেনেসাঁসের যাত্রা।

বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতির যে রেনেসাঁ তা ডিরোজিও, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মাইকেল, অক্ষয়কুমার প্রমুখ মনীষীর কর্মকীর্তি ও জীবনাদর্শের পথ ধরেই উৎসারিত হয়েছে। ১৯২৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও আবুল হোসেন সম্পাদিত শিখা পত্রিকা তাঁকে চমৎকৃত করেছিল এবং দ্বিধাহীনভাবে তিনি এই আন্দোলনকে রেনেসাঁর মর্যাদা দিয়েছেন।

স্রোতের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ গ্রন্থে শিবনারায়নবাবু তাঁর সহজাত বুদ্ধি, যুক্তি, প্রশ্ন ও আত্মজিজ্ঞাসার প্রখর চিন্তাচেতনায় ধর্মবর্ণ জাতি নিরপেক্ষ এক জগত গড়ার দিকে নিবিষ্ট হয়েছেন যা দেশকালের সীমানা পেরিয়ে প্রতিটি দেশের যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষিত সমাজ তথা বিশ্বমানব কল্যাণের কথাই বলে। এই গ্রন্থে ‘নাস্তিকের মৃত্যুচিন্তা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন ‘অতিমানব বলে বিশ্বজগতে কিছু নেই, শব্দটি মানুষের আকাার প্রকাশ মাত্র, কিন্তু অস্মিতাসম্পন্ন ব্যক্তির প্রভাব অনেক বেশি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কৃতি তার মৃত্যুর পরেও দীর্ঘস্থায়ী ইতিহাসে তার প্রমাণ মেলে। বুদ্ধ, সক্রেটিস, কনফুসিয়াস, যিশু, মোহাম্মদ, কান্ট, মার্কস, রবীন্দ্রনাথ, পিকাসো এরা প্রত্যেকেই অনন্য অস্মিতাসম্পন্ন মানুষ। তবে এরা কেউ অজর, অমর, ত্রুটিবিচ্যুতিহীন আত্মা বা ‘বিশ্বমানব’ বা বিচারের উর্ধ্বে ‘অতিমানব’ নন।

দেশ’ পত্রিকায় যখন শিবনারায়ণের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ ও গ্যোটে’ প্রকাশিত হয় তখন তাঁকে নিয়ে প্রবল সমালোচনায়মুখর হয়ে তৎকালীন সাহিত্যসংস্কৃতি জগত। বাঙালি হয়ে বাংলায় লেখা ভালো না বলে কোনো এক গ্যোটে কে তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় প্রতিভাবান মনে করছেন। এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত ছিল ‘গ্যোটে বেশ্যাবাড়ি গিয়েছেন, মদ খেয়েছেন, মেয়েদের হৃদয় ভেঙেছেন। সে সব তিনি লুকিয়ে রাখেন নি। সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এটা পারেন নি। বাস্তব জীবন রবীন্দ্রনাথের লেখায় দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে।

এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন ‘আমার মতে বাংলার রেনেসাঁসের সবচেয়ে বড় কীর্তি হল বাংলা গদ্যের বিকাশ। বাংলার চিন্তা, বাংলার মনন, সারা ভারতবর্ষকে একশো বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল’। এই বিকশিত বাংলা গদ্যের একটি বিশিষ্ট রূপকল্প নিঃসন্দেহে প্রবন্ধ সাহিত্য। কিন্তু শিবনারায়ণ মনে করতেন ‘বাংলা প্রবন্ধের অস্পষ্টতা এবং দারিদ্র্য প্রায় একেবারেই ঘোচেনি। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য নিতান্তই অপরিণত। বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের উন্নতিকল্পের সারস্বত সংকল্প নিয়ে শিবনারায়ণ ১৯৮০ সালে প্রকাশ করলেন মনন ও চিন্তন নিকষিত জিজ্ঞাসামুখর প্রবন্ধমুখ্য ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’। বাইশ বছর নিরবচ্ছিন্ন সম্পাদনায় এ কে শক্ত জমির ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্পাদক শিবনারায়ণ। বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে এবং প্রবন্ধসাহিত্যের সৌষ্ঠবসাধনে ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার অবদান উপেক্ষণীয় নয়।

শিবনারায়ণ কোনো তত্ত্বদর্শনের আবেষ্টনীতে নিশ্চল হয়ে থাকেননি। মননের চলিষ্ণুতা, অভিজ্জতার প্রাচুর্য, তীক্ষ্‌ণ বিশ্লেষণ শক্তি এবং সর্বোপরি স্বাধীন চিন্তা তাঁকে সজীব সচল করে রেখেছে একজন সংবেদী মানুষ হিসেবে। মননদৃষ্টির এই ক্রম পরিবর্তনের নির্যাস তাঁর রচনাসম্ভারেও পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানী গবেষকপাঠক তৎপর হতে পারেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধপিঠার পিঠে