শিপিং সেক্টরে ভেন্ডরের উৎপাত

এনওসি দিতে চাপ, বিভিন্ন অফিসে চড়াও অভিযোগ গেল সিএমপি কমিশনারসহ বিভিন্ন দফতরে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শিপিং সেক্টরে নতুন উৎপাত হিসেবে দেখা দিয়েছে ভেন্ডরের কাজ হাতানোর চাপ। বিভিন্ন শিপিং এজেন্সির কাছে ভেন্ডরের কাজ দেওয়ার জন্য দলে দলে হানা দেওয়া হচ্ছে। ভেন্ডরের এনওসি না পেয়ে শিপিং এজেন্সির মালিক এবং কর্মচারীদের হুমকি দেওয়া এবং মারধরের ঘটনাও ঘটছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। বিরক্ত এবং শংকিত এজেন্সির মালিকরা সাংগঠনিকভাবে বিষয়টি সিএমপি কমিশনারকে জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। একইসাথে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের নিকটও বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমুদ্রগামী জাহাজের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে শিপিং এজেন্সিগুলো কাজ করে। বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করার পর থেকে জাহাজ এবং নাবিকদের যাবতীয় দেখভাল ও প্রয়োজন মিটায় শিপিং এজেন্সি। প্রতিটি জাহাজ কোনো বন্দরে যাওয়ার পর তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন দেখা দেয়। বাজার থেকে শুরু করে জাহাজ পরিষ্কার করে আবর্জনা অপসারণ, অপ্রয়োজনীয় জিনিস জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা, জাহাজের প্রয়োজনীয় রং করা, ওয়েল্ডিং, টুকটাক মেরামতসহ নানা ধরনের কাজ সারতে হয় জাহাজগুলোকে। চট্টগ্রাম কাস্টমস এবং বন্দরের অনুমোদিত ভেন্ডর লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরা শিপিং এজেন্সির এনওসি নিয়ে এসব জাহাজে ওঠে এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দেয়।

আপাতত দৃষ্টিতে ভেন্ডরদের কাজ সামান্য মনে হলেও বাস্তবে এই কাজের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় করা যায়। জাহাজের নাবিকরা নানা ধরনের জিনিসপত্র ভেন্ডরদের কাছে বিক্রি করে দেন। অনেক সময় জাহাজের মালিকের অগোচরে মূল্যবান জিনিসপত্রও নাবিকরা ভেন্ডরদের মাধ্যমে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেন। অনেক জাহাজ তেল বিক্রি করে দেয়, ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে। আবার অনেকে ডলার কিনে নেয়। জাহাজের খুচরা যন্ত্রপাতিও সুযোগ পেলে বিক্রি করে দেন নাবিকরা, যা ভেন্ডররা বাইরে এনে চড়া দামে বিক্রি করেন। এনওসি পাওয়া মানেই ওই জাহাজের ভেন্ডরের কাজ এবং এই কাজের সুযোগে লাখ লাখ টাকা আয় করা। একেকটি জাহাজে কাজের জন্য ভেন্ডরের এনওসি ৭০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়, যা দিয়ে আয় করা যায় ২ থেকে ১০১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

একসময় ভেন্ডর লাইসেন্সের তেমন কদর না থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে এটি লোভনীয় ব্যবসা হয়ে ওঠে। জাহাজের ভেন্ডর নিয়োগের এনওসি নিয়ে আগেও বিভিন্ন সময় নানা অঘটন ঘটেছে। বিগত সরকারের শাসনামলে সরকারি দলের প্রভাবশালী অনেকে বিভিন্ন শিপিং এজেন্সি থেকে ভেন্ডর লাইসেন্স হাতিয়ে নিয়ে ব্যবসা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার পতনের পর ভেন্ডরের ব্যবসায় নজর পড়ে অনেকের। এরা দলে দলে বিভিন্ন শিপিং অফিসে গিয়ে ভেন্ডরের এনওসির জন্য হানা দিচ্ছে বলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন পুলিশ কমিশনারের নিকট লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে।

এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক শিপিং ব্যবসার প্রতিনিধি হচ্ছে শিপিং এজেন্সি। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার নিয়ম কানুন মেনে তাদেরকে চলতে হয়। কিন্তু ভেন্ডরের এনওসির জন্য বেশ কিছুদিন ধরে সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিভিন্ন শিপিং অফিসে চড়াও হচ্ছে।

এভারেট বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডে সংঘটিত একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, একদল দুর্বৃত্ত এভারেট শিপিংয়ের অফিসে গিয়ে ভেন্ডরের এনওসির জন্য হামলা ও ভাঙচুরসহ কর্মকর্তাকর্মচারীদের সাথে অশালীন আচরণ করে। তারা নানাভাবে হুমকি দেয়। ঘটনার ব্যাপারে ডবলমুরিং থানায় জিডি করার কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, শুধু এভারেট শিপিংয়ে নয়, সংগঠনের অন্যান্য সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ভেন্ডরের এনওসির জন্য চক্রটি চড়াও হচ্ছে। আবার এমন অনেকে চড়াও হচ্ছে যাদের কাছে কাস্টমস এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ভেন্ডর লাইসেন্সই নেই।

লাইসেন্সবিহীন কাউকে ভেন্ডর নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, শিপিং এজেন্সি ইচ্ছে করলে কাউকে এনওসি দিতে পারে না। এক্ষেত্রে ভেন্ডর লাইসেন্স রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে জাহাজ মালিকেরও অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু কোনো কিছু না মেনে অনেকটা গায়ের জোরে ভেন্ডরের এনওসির জন্য হানা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে গায়ের জোরে কাউকে ভেন্ডর হিসেবে জাহাজে পাঠানোর জন্য এনওসি দেওয়া হলে তা আন্তর্জাতিক শিপিং সেক্টরে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।

পুলিশ কমিশনার বরাবরে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফের লেখা চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনারসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দফতরে।

সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ আজাদীকে বলেন, ভেন্ডরের এনওসির চাপে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। এটি শিপিং সেক্টরে একটি নতুন আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই উৎপাত বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা বহিষ্কার
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের পাহাড়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় ১০৫ মানবাধিকার আইনবিদের বিবৃতি