শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা, শিখরে পৌঁছানোর অঙ্গীকার

সিভাসু দিবস উদযাপন ২০২৫

অধ্যাপক মোঃ আহসানুল হক রোকন | বৃহস্পতিবার , ৭ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

একটি সুস্থ ও টেকসই বাংলাদেশ গড়ে তোলার দূরদর্শী লক্ষ্য নিয়ে ৭ আগস্ট, ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), যার লক্ষ্য ছিল শিক্ষা, গবেষণা এবং সমাজসেবার মাধ্যমে ভেটেরিনারি ও প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানে ইতিবাচক পরিবর্তন ও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। এই যাত্রার শুরুটা ছিল ১৯৯৫৯৬ শিক্ষাবর্ষে, চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বিশেষায়িত ভেটেরিনারি শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, ইউসুফ চৌধুরী (দৈনিক পূর্বকোণের প্রাক্তন মালিক), নাজির আহমেদ (প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রাক্তন মহাপরিচালক), অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ (সিভাসুএর প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য) এর মতো ব্যক্তিত্বরা এই আনুষ্ঠানিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে ‘সিভাসু আইন’ পাস হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম পাবলিক ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ খুলে দেয়।

সিভাসু তার কার্যক্রম শুরু করেছিল ছোট পরিসরে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত একটি উৎকর্ষ কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস খুলশীতে অবস্থিত, পাশাপাশি হাটহাজারী ও কক্সবাজারে গবেষণা ক্যাম্পাস এবং ঢাকার পূর্বাচলে একটি পোষা প্রাণী হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। চারটি অনুষদ ভেটেরিনারি সায়েন্স, ফুড সায়েন্স ও টেকনোলজি, মৎস্যবিজ্ঞান এবং বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং দ্বারা দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলার পাশাপাশি উদ্ভাবন, গবেষণা এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে।

সিভাসু ব্যবহারিক শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রসারে বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারে সামুদ্রিক মাছের হ্যাচারি, হাটহাজারীতে খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটিতে গবেষণা জাহাজ এবং ঢাকার পূর্বাচলে একটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণভিত্তিক পোষা প্রাণী হাসপাতাল। এ ছাড়া পোল্ট্রি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট সংক্রমণ ব্যাধি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এবং এক স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিভাসুরএর একটি বিশেষ মাইলফলক হল এনাটমি জাদুঘর যা বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক এনাটমি মিউজিয়াম হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এখানে রয়েছে ২,০০০ টিরও বেশি কঙ্কালের নমুনা এবং ৩,০০০ হিস্টোলজিক্যাল স্লাইডের সমৃদ্ধ সংগ্রহ এবং একটি মৎস্য জাদুঘর, যা বাংলাদেশের স্বাদুপানির এবং সামুদ্রিক পরিবেশের জীববৈচিত্র তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং পাঠ্যক্রম শক্তিশালীকরণের শিল্প হিসেবে, সিভাসু তার একাডেমিক কাঠামো উন্নত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন কর্মভিত্তিক শিক্ষা, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব এনিম্যাল হেলথটাফটস টুইনিং প্রকল্প, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয় অংশীদারিত্ব প্রোগ্রাম, বাংলাদেশে লাইভ পোল্ট্রির ব্যবসা এবং লালন পালনে আচরণগত অভিযোজন এবং জুনোসিস প্রতিরোধ (বালজাক), ওয়ান হেলথ পোল্ট্রি হাব, আডার হেল্‌থ বাংলাদেশ, সমস্যা ভিত্তিক শিক্ষণ (পিবিএল), পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, ক্লিনিকাল দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি।

শিক্ষাগত উৎকর্ষতার অংশ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবার বাংলাদেশে ২০১৪ সালে পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে ভেটেরিনারি নীতিশাস্ত্র এবং প্রাণী কল্যাণ চালু করেছে। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব এনিম্যাল হেল্‌থ টাফটস টুইনিং প্রকল্পের মাধ্যমে সিভাসু তার ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) পাঠ্যক্রমকে বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের সাথে সম্পূণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য নতুনভাবে কাজ করেছে। ফিল্ড ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য কন্টিনিউয়িং এডুকেশন সেশন এবং ক্লিনিকাল দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ইন্টার্নশিপ সংস্কার করে ছাত্রছাত্রীদের ‘প্রথম দিনের দক্ষতা’ অর্জন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় শিক্ষার্থীরা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানের অংশীদার বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশ নিচ্ছে।

গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও সিভাসু অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। কোভিড১৯ অ্যান্টিবডি সার্ভেইলেন্স, সার্সকোভ২ ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোম সিকোয়েন্সিং, এবং জাতীয় ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী প্রস্তুতি পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও উদ্ভাবিত হয়েছে প্রোটিনসমৃদ্ধ কাঁঠাল চিপস, সুরিমি পণ্য, যা খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন দিক উন্মোচন করেছে। ২০২৪ সালের গবেষণা ও প্রযুক্তি উৎসবে ৩৫০টির বেশি গবেষণা উপস্থাপনা এবং ৯৫টির বেশি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ সিভাসুর সক্ষমতার প্রমাণ।

এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের শুধু বিদ্বান নয়, বরং ভবিষ্যতের নেতৃত্বে সক্ষম করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানকার প্রাণবন্ত ছাত্রনেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলোযেমন ইন্টারন্যাশনাল ভেটেরিনারি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ওঠঝঅ), সিভাসু মডেল ইউনাইটেড নেশন, সিভাসু ডিবেটিং ক্লাব, ওয়ান হেলথ ইয়াং ভয়েস, ফিশ বুথ ক্লাব প্রভৃতিছাত্রদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক সংলাপে সম্পৃক্ত করছে।

তবে এই উন্নয়নের পথ সম্পূর্ণ মসৃণ নয়। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সিভাসু নানা কাঠামোগত ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। প্রাথমিক সমস্যাগুলির মধ্যে একটি হল সীমিত জমি, অবকাঠামো এবং সক্ষমতা বিষয়ক সীমাবদ্ধতা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি কক্সবাজারে মেরিন রিসার্চ সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগসুবিধা স্থাপন করেছে, তবুও অনেক বিভাগে এখনও উন্নত ল্যাবরেটরি স্থান এবং আধুনিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে আণবিক জীববিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং জৈব তথ্যপ্রযুক্তির মতো অত্যাধুনিক ক্ষেত্রগুলির জন্য। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ল্যাব, গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্র কখনও কখনও বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে প্রাতিষ্ঠানিক সমপ্রসারণ ও দক্ষতা উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য।

পরিশেষে, ২০২৫ সালে সিভাসু দিবস উদযাপন করার সময় আমরা কিছু অগ্রণী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই: একজন হলেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ (২০০৬২০১০), যিনি এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং প্রথম এক স্বাস্থ্যের ধারণা দিয়েছিলেন। আমরা সম্মান জানাতে চাই জননেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সমাজনেতা ইউসুফ চৌধুরী এবং নাজির আহমেদ (মহাপরিচালক প্রাণিসম্পদ) এর মতো ব্যক্তির অটল নেতৃত্ব এবং সমর্থনকেযাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নিষ্ঠা এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)কে তাদের অব্যাহত নির্দেশনা এবং আর্থিক সহায়তার জন্য। আমরা গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই চারটি অনুষদের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি যাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় সকল অনুষদের একাডেমিক উৎকর্ষতা এবং নতুন নতুন উদ্ভাবন বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয় নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব, সহায়ক প্রাক্তন ছাত্রদের নেটওয়ার্ক এবং দৃঢ় সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত। আজকের এই বিশেষ দিনে আমাদের আশা থাকবে, সিভাসু উৎকর্ষের কেন্দ্র হিসেবে বেড়ে উঠে বাংলাদেশ এবং বাইরের বিভিন্ন দেশে উদ্ভাবন, শিক্ষা এবং পরিষেবাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে একটি স্বাস্থ্যকর, টেকসই ভবিষ্যতের নিকটে।

লেখক : মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগ, ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ পরিচালক, ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক করল হিরোশিমা
পরবর্তী নিবন্ধজুলাই গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়