শিক্ষা-শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: রবীন্দ্র ভাবনা

প্রফেসর (ডাঃ) প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া | রবিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ


সূচনাঃ এক ঝাঁক মেধাবী ছাত্র ছাত্রী জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে, বিশাল মঞ্চের মুখোমুখি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, এক নজর চোখ পড়ে ডান-বামে। নিমিষে পলক ছুটে যায় মঞ্চাসীন বিভিন্ন রথী-মহারথীদের মুখমণ্ডল পানে। আমরা ও বড় হবো, ডিগ্রি ধারী হবো। পরিবারের মুখোজ্বল করবো। যে ভাবে জন্মদিনে পিতা-মাতা আশার জাল বুনেছেন। ‘মানুষের মত মানুষ হবো, মানবের মঙ্গল বারতা বয়ে আনুক’, এ প্রত্যয়ে। এমতাবস্থায়, স্মার্ট সঞ্চালক একে একে নাম ঘোষণা করেন, জনৈক শিল্প উদ্যোক্তা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, মস্তবড়ো ডাক্তার, নামযাদা প্রকৌশলী, ডাকসাইটে প্রফেসর, দেশজোড়া পরিচিত উকিল-ব্যারিষ্টার, কবি-লেখক, মহা নিরীক্ষক চার্টার্ড এ্যাকাউনটেন্ট এবং ত্যাগী গুণী ট্রাষ্টিদের বিশেষণ শুদ্ধ নাম, পদবী ও সুনাম। বি বি এফ এর বার্ষিক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানটি বিহারের চৌহদ্দির বাইরে। সুধী মণ্ডলীরাও চোখ কেড়ে আসন অলংকৃত করেছেন। বৃত্তি প্রদান, বেদ বাক্য বচন, ছাত্রদের ভুত-ভবিষ্যৎ এবং ঠাসা ঠাসা উপদেশ যেন এক মহাসভায় পরিণত হয়েছে।
প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ঃ শিক্ষার্থী, শিক্ষক সমাজ এবং শিক্ষালয় বা বিদ্যাপীঠ: অনুষঙ্গ রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে শিক্ষা কি? আমরা জানি, শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনে সক্ষম করে তুলে। শিক্ষা লাভের একটা প্রান্তিক উদ্দেশ্য থাকে সার্টিফিকেট বা সনদ প্রাপ্তি। উপনিবেশিক আমল থেকে সার্টিফিকেট কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সমাজ ও ব্যক্তির অস্তিত্বের জন্য শিক্ষাই একমাত্র অবলম্বন। শিক্ষা জাতির সম্পদ বা মূলধন। একটি নিন্ম আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীতকরণে বাংলাদেশের কার্যকর শিক্ষা একটি বড় নির্ণায়ক। শিক্ষা জাতিকে শিল্প সমৃদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক অংগনে জাতির মর্যাদা বৃদ্ধির সম্পূরক। অভিজ্ঞতা দক্ষতা ও সুশিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এক কথায়, সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য খাদ্য, সবার জন্য স্বাস্থ্য এবং সুশাসন সহ সকল মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই সবাই।
লেখকের হাতে খড়ি হয়, স্বর্গীয় কাকা বলরাম বড়ুয়ার সস্নেহে। বারান্দায়, পাটিতে, কেরোসিন কুপির শিখায়। লেম্প, টেবিল ও চেয়ার হাইস্কুলে পড়ার সময় পেয়েছি। গুরুগৃহ, জানালা বিহীন মাটির পাঠশালা, বিহারে টোলের পড়া এবং টিনশেড মাটির হাই স্কুলে। কাঁদা, ধূলো পায়ে মেখে পাজামা ভিজিয়ে স্কুলে পৌঁছি। উপকরণের বর্ণনা এ কারণে আমাদের সময় ভগ্নপ্রায় মাটির আলয়ে মহান শিক্ষকেরা পাঠদান করতেন। ব্রতী গুরুবৃন্দ জ্ঞান, চরিত্র, সাহস এবং বুদ্ধি পরামর্শ অঢেল দিয়েছেন। জনৈক, উর্ধতন সচিব (সন্দীপ জন্মজাত) অনুরূপ গ্রামের স্কুল থেকে পাশ করে ক্ষোভের সাথে আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের সভায় বলেন, ‘বর্তমান আধুনিক দালানে বৈদ্যুতিক আলোতে সেকালের আদর্শবান ও নৈতিকতায় ঋদ্ধ শিক্ষক কি একালে বিদ্যমান’? লেখক হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় এক অপরাহ্নে স্বর্গীয় মাতৃদেবীর সামনে শিক্ষানুরাগীর পিতা জীবনের লক্ষ্য (অরস রহ ষরভব), ‘তোমাকে অবশ্যই ডাক্তারী পড়তে হবে। এতে গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা যায় এবং সম্মানেরও প্রাপ্তি ঘটে।’ পরবর্তী বছরে বাবা আরো আত্মবিশ্বাস, আকাঙ্খা ও আশীর্বাদের প্রশ্রয়ে আবদার করেন, ‘তোমাকে অবশ্যই অবশ্যই বিজ্ঞানে ফার্স্ট ডিভিশন পাশ করতে হবে। অন্যথায় আমার কলিজা পোড়া যাবে না।’ একজন শিক্ষক হিসেবে এখন বুঝতে পারি বাবা একজন সফল প্রেরণা দাত্রী অভিভাবক যিনি ছাত্রদের ঋড়ংঃবৎরহম করতে সক্ষম ছিলেন। একজন পরিপূর্ণ অভিভাবক বাবা শিক্ষকদের বলতেন, ‘আমি জন্মদাতা মাত্র, আপনারা হচ্ছেন শিক্ষাদাতা বা নতুন জীবন দাতা।’ অত্র প্রবন্ধের নির্যাসে একজন অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনে লেখকের পিতার উপদেশ উদ্ধৃত করলাম, কখনো আত্ম প্রসাদের জন্য নয়।
অত্র প্রবন্ধে বাহুল্য না বাড়িয়ে, বহুল আলোচিত ও বাংলা ভাষায় অনন্য বিদ্যাপীঠ শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বকবির কিছু ভাব, চিন্তা-ভাবনার উল্লেখ করা হচ্ছে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে আগস্ট ১৯০১ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যালয়ের আদর্শ নিয়ে লিখেন, ‘‘…শান্তি নিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীন কালের গুরু গৃহ বাসের মতো নিয়ম। বিলাসিতার নাম-গন্ধ থাকিবে না- ধনী-দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হইতে হইবে’’। কবির পরামর্শ ছিল, কর্মযোগী মানুষ তৈরী করা যারা মনুষ্যত্ব বিকাশ সাধনে নিবিষ্ট হবেন।
কবিগুরু পরের বছর ৭ ই এপ্রিল ১৯০২, ব্রজেন্দ্র কিশোর দেববর্মা কে শিক্ষার নীতি ও অন্তনিহিত কৌশল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘শান্তিতে, সন্তোষে, মঙ্গলে, ক্ষমায়, জ্ঞানে, ধ্যানেই সভ্যতা; সহিষ্ণু হইয়া, সংযত হইয়া, পবিত্র হইয়া, আপনার মধ্যে আপনি সমাহিত হইয়া, বাহিরের সমস্ত কলরব ও আকষর্ণকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সহিত একাগ্র সাধনার দ্বারা পৃথিবীর মধ্যে প্রাচীনতম দেশের সন্তান হইতে, প্রথমত সভ্যতার অধিকারী হইতে, পরমতম বন্ধনমুক্তির আস্বাদ লাভ করি তে প্রস্তুত হও। … ’’ কবি প্রায় সোয়া শতবর্ষ আগে এ প্রবচনে ভারতীয় সভ্যতা বিকাশ এবং সর্বোপরি আত্মহিত ও পরহিত শ্রেষ্ঠ বিমুক্তির অমৃত স্বাদ লাভে শিক্ষার্থীদের আত্ম গঠন ও মর্যাদায় প্রস্তুত হতে আহবান করেন।
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন কে (নোবেল জয়ী অমর্ত সেন এর পিতা), ২৪শে এপ্রিল ১৯০৮ রবীন্দ্রনাথ পরামর্শ দেন, ‘‘… বিদ্যালয়কে আকৃতি দান, ইহা প্রকৃতিকে উদ্বোধিত করিয়া তোলা কোন এক ব্যাক্তির শাসনাধীন হইবে না। আমি চেষ্টা করি যাহাতে প্রত্যেক অধ্যাপক নিজের শক্তিকে স্বাধীনভাবে এই বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করিতে পারেন।’’…. শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা ও সৃজনশীলতা বিকাশের বিশাল সুযোগ তৈরি করে দেন শান্তি নিকেতন স্থপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতবর্ষের পরাধীনতার ছোবল ও মিথ্যার বেড়াজাল থেকে মুক্ত মনন উজ্জীবিত হয়, তৎজন্য স্পষ্ট ভাবে উক্ত পত্রে নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ে সত্যের যেন অবমাননা না হয়- ছাত্রেরা যেন সত্যকে নির্ভয়ে স্বীকার করিয়া জীবনকে ধন্য করিতে পারে সেই পরম শক্তি তাহাদের মধ্যে সঞ্চার করিতে হইবে -এই আমার একান্ত কামনা জানিবেন।’’
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহোদয়কে ৪ নভেম্বর ১৯০৯, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবগত (সতর্কীকরণ) করেন, ‘‘রথী একটা কথা লইয়া দুঃখ প্রকাশ করিলেন যে, অধ্যাপক দের কেহ কেহ ছাত্র সমক্ষেই অন্য অধ্যাপক ও ছাত্রদের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন- শুনিয়া আমি ও ক্ষোভ অনুভব করিলাম।’’ শিক্ষকদের আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে রবি ঠাকুরের ১৯০২ খৃঃ অক্টোবর মনোরঞ্জন বন্ধোপাধ্যায়কে বলেন, ‘‘অধ্যাপকদের প্রতি ছাত্রদের নির্ব্বিচারে ভক্তি থাকা চাই। তাঁহারা অন্যায় করিলে ও তাহা বিনা বিদ্রোহে নম্রভাবে সহ্য করিতে হইবে।… … বিলাসত্যাগ, আত্মসংযম, নিয়মনিষ্ঠা, গুরুজনে ভক্তি সম্বন্ধে আমাদের দেশের প্রাচীন আদর্শের প্রতি ছাত্রদের মনোযোগ অনুকূল অবসরে আকর্ষণ করিতে হইবে।’’
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তরালে তাঁর শিক্ষা দর্শন আজবধি তাৎপর্য পূর্ণ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদুনাথ সরকারকে তাঁর প্রত্যয়, ‘বৈজ্ঞানিকতাকে আমি যেমন মানি ভাবুকতাকে ও তেমনি মানি,….. ভাবুক বলিয়া আপনি আমাকে প্রত্যাখান করিলেও সত্যসাধক বলিয়া শেষপর্যন্ত আপনার প্রতীক্ষা করিব।’’
১২ ই জুন ১৯০৪ খৃঃ মোহিত চন্দ্র সেনকে বিশ্বকবি বিচিত্র ও বহুমাত্রিক জ্ঞান অর্জনে পরামর্শ দেন, ‘‘ছেলেদের নিয়মিত সাহিত্য চর্চা প্রয়োজন- তার ব্যবস্থা করবেন। প্রত্যেক ছেলের সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়েই অর্থাৎ লেখা পড়া, রসচর্চা, অশনবসন, চরিত্র চর্চ্চা, ভক্তিসাধন, প্রভৃতি সব তাতেই আপনি ঘনিষ্ঠ যোগ রাখবেন- আপনি তাদের বিধাতার প্রতিনিধি হবেন।’’
আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন মহোদয় কে ৪ ঠা নভেম্বর ১৯০৯ইং, মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করে দেন, ‘‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সম্যক পরামর্শ ছিল ছাত্রদিগকে ধর্মশিক্ষাদান সম্বন্ধে শান্তি নিকেতন ট্রাষ্ট ডীডের বিধিলঙ্গন করা চলিবে না। কোন অধ্যাপক ছাত্রদিগকে বিশেষ ভাবে ধর্মমত সম্বন্ধে কোনো সাম্প্রদায়িক পন্থায় চালনা করিবার চেষ্টা মাত্র করিবেন না।’’ উক্ত পত্রে সাম্য, মৈত্রী, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র চর্চায় এক অনবদ্য উদার শিক্ষা নীতি রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তন করেন, ‘‘বুদ্ধ, খৃষ্ট, মহম্মদ, চৈতন্য, নানক, কবীর, রামমোহন প্রভৃতি মহাপুরুষদের মৃত্যুদিনে উৎসব করিতে হইবে, সেই দিনটি তাহাদের জীবনী ও উপদেশ ব্যাখা ও রচনা পাঠ বা গান করিবার দিন। আশ্রমের পশুপক্ষী তরুলতার সহিত ছাত্রদের চিত্তের যোগসাধনের জন্য চেষ্টা করা আবশ্যক।….. বনের উৎসব, বর্ষায় সপ্তোপর্ণ কুসুমোদ্‌ গমের উৎসব, শরতে শেফালী তলের উৎসব, বসন্তে শালমঞ্জরীর উৎসব উপযুক্ত বেশ, সঙ্গীত ও ভোজ্যের দ্বারা সমাধা করিতে হইবে।’’ ২ নভেম্বর ১৯১১ইং, নেপাল চন্দ্র রায়কে একটি প্রাচীন প্রবাদে সার্বজনীনতা পরম দৃষ্টান্ত তোলে ধরেন, ‘‘প্রাচীন তপোবনে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু মুসলমানে একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা। আবার একবার বিবেচনা করিবেনও চেষ্টা করিবেন যে আপনাদের আশ্রমদ্বারে আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না।’’
এহেন আন্তর্জাতিক সুশিক্ষার নীতি সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান সমগ্র বিশ্বে দুর্লভ। প্রকৃতি- পরিবেশ ভারসাম্য সুরক্ষায় রবী ঠাকুরের পরামর্শ অতুলনীয়, ‘‘বিদ্যালয় সন্নিহিত কাননভূমিকে কয়েক ভাগ বিভক্ত করিয়া এক একদল ছাত্রের প্রতি তাহার পরিচর্যাভার অর্পন করিতে হইবে।… প্রত্যেক বালক একটি করিয়া বৃক্ষ রোপণ করিবে এবং প্রত্যহ দুইবেলা তলা খুঁড়িয়া তাহাতে জলসেচ করিবে– আশ্রমের পাখী ও কাঠবিড়ালি প্রভৃতি জন্তুদিগকে বন্দী না করিয়া ছাত্রগণ আহারাদি দিয়া পোষ মানাইবার চেষ্টা করিবে। এই কার্যে যে ছেলে সর্বাপেক্ষা কৃতকার্য হইবে তাহাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হইবে।’’ অধিকন্তু, ছাত্রদের ভৃত্যদিগকে সেবার জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট দিবস ঠিক করা হয়, যখন ছাত্ররা খাদ্য পরিবেশন করবে, কাব্য ও কথা শুনাইয়া আনন্দ উচ্ছ্‌বাস ছাত্রদের চিত্তের উদ্বোধিত করে তুলবেন। তরুলতা, প্রকৃতি ও পরিচর্যাকারীদের অন্তরের যোগসাধনা ও প্রেম প্রীতি উৎপন্ন হয়।
ছাত্রদের স্বনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী করে তুলার জন্য ভুপেন্দ্রনাথ সান্যাল কে ১৭ ই সেপ্টেম্বর ১৯০৭ এ রবীঠাকুর লিখেন, ‘‘ছেলেরা যখন রাঁধিবে তখন যাহতে অগ্নিকান্ড না হয়, তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখিবেন তাই বলিয়া রান্না বন্ধ করিয়া দেওয়া ঠিক নয়।’’ এহেন বাস্তব জীবনধর্মী শিক্ষা শিশু কিশোরদের জন্য আবশ্যক ও জীবনযুদ্ধে ফলপ্রসূ হবে নিঃসন্দেহে।
মনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়কে ২৮শে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘‘পরীক্ষা পাশ করাবার ইস্কুলটি বিশ্বভারতীর আদর্শসঙ্গত জিনিষ নয়- দেশে এই উদ্দেশ্য নিয়ে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান আছে।’’ সন্তোষচন্দ্র মজুমদার কে ১৯ শে মে, ১৯২৬ তিনি পরিস্কারভাবে মত প্রকাশ করেন, ‘‘…. বিশ্ববিদ্যালয়ের কলে তৈরি শিক্ষা আমাদের আদর্শ নয়, শিক্ষার মধ্যে জীবন সঞ্চার করতে হবে।’’ এহেন আদর্শিক ক্ষেত্রে আলবার্ট আইনস্টাইনের পরীক্ষা সংক্রান্ত উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ছোট বয়সে পরীক্ষার চাপকে দুঃস্বপ্ন, স্কুল যেন কারাগার, বন্দীশালা।’’ উপরোক্ত বিষয় ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথের স্কুলে অনুশীলন করা হত। শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি শিক্ষার্থী পরিবার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শৈশব ও কৈশোরের কিছু ফলিত দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা সমীচিন।
প্রবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি এখানে উল্লেখ্য, তিনি নর্মাল স্কুলে প্রায় ছ’বছর পড়েন। ১৮৫৪ সনে কলিকাতার গভর্নমেন্ট নর্মাল বিদ্যালয় বা সংক্ষেপে নর্মাল স্কুলটি সংস্কৃতি কলেজের সঙ্গে যুক্ত হয়। স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণীতে অক্ষর জ্ঞান, বানান, ব্যাকরণ, গণিত, বীজগণিত, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস, ক্ষেত্রপরিমাপক বিদ্যা, জ্যের্তিবিদ্যা, বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয় ও গর্ভমেন্ট আইন ইত্যাদি বিষয় কলেজের অধীনস্থ বাংলা পাঠশালায় পঠন-পাঠন হয়। উক্ত স্কুলের শিক্ষক শ্রীযুক্ত নীল কমল ঘোষাল রবীন্দ্রনাথের গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত একটানা পড়াতেন। স্কুলে যা পাঠ্য ছিল তার থেকে অধিক পরিমাণ পড়তে হতো বাড়িতে। পড়াশুনার সূচি বিন্যস্ত ছিল- ‘‘ভোরে অন্ধকার থাকিতে উঠিয়া লংন্টি পরিয়া প্রথমেই এক কানা পালোয়ানের (হারা সিং) সঙ্গে কুস্তি করিতে হইত। তাহার সেই মাটি মাখা শরীরের উপর জামা পড়িয়া মেঘনাথবধ কাব্য, জ্যামিতি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল শিখিতে হইত। স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিলে ড্রয়িং এবং জিমন্যাসটিকের মাস্টার আমাদিগকে লইয়া পড়িতেন। সন্ধ্যার সময় ইংরেজি পড়াইবার জন্য অঘোর বাবু আসিতেন। এরূপে রাত্রি ন’টার পর ছুটি পাইতাম। রবিবার সকালে বিষ্ণুর কাছে (বিষ্ণু চন্দ্র চক্রবর্তী) গান শিখিতে হইত। প্রায় সীতনাথ দত্ত আসিয়া যন্ত্র-তন্ত্র যোগে প্রাকৃত বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। এই শিক্ষাটি আমার কাছে বিশেষ উৎসুক্যজনক ছিল। ইহা ছাড়া ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে একটি ছাত্রের কাছে কোন এক সময়ে অস্থিবিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করিলাম। ইহারই মাঝে এক সময়ে হেরম্ব তর্করত্ন মহাশয় আমাদিগকে একেবারে ‘মুকুন্দং সচ্চিদানন্দং’ হইতে আরম্ভ করিয়া মুগ্ধবোধের সূত্র মুখস্ত করাইতে শুরু করিয়া দিলেন। …. বাংলা শিক্ষা যখন বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে তখন আমরা ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়াছি।’’ ইহা প্রতীয়মান হয় যে বৃহৎ জাতি- চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জাপানের মতো রবীন্দ্রনাথ শৈশবে মাতৃভাষায় সকল প্রকারের পুথিগত ও ব্যবহারিক বা ফলিত বিদ্যা চর্চা ও অনুশীলনে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বপ্নাদ্রষ্টা ও অগ্রদূত ছিলেন।
উপসংহারে, ১৫ ই জুলাই, ১৯৩৫ খৃঃ ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে লিখিত দলিল আজকে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও মূলায়নের উৎকৃষ্ট সময়, ‘‘একদিন দেখেছিলাম শান্তি নিকেতনের পথে গরুর গাড়ীর চাকা কাদায় বসে গিয়েছিল, আমাদের ছাত্ররা সকলে মিলে ঠেলে গাড়ী উদ্ধার করে দিলে; সেদিন কোন অভ্যাগত আশ্রমে যখন উপস্থিত হলেন, তার মোট বয়ে আনাবার কুলি ছিল না, আমাদের কোনো তরুণ ছাত্র সসংকোচে তাঁর বোঝা পিঠে করে নিয়ে যথাস্থানে এনে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল- অপরিচিত অতিথিমাত্রের সেবা ও আনুকূল্য তাঁরা কর্তব্য বলে জ্ঞান করতো।’’ আজকের শিক্ষা অনুষঙ্গ পর্যালোচনায় বহুমাত্রিক ভাবনার বিষয় বিবেচ্য। মনোজগত, কায়িক, পারিপার্শ্বিক এবং সর্বোপরি মহাশিক্ষক বা গুরুর ত্যাগ এবং শ্রম অতীব আবশ্যক নির্ণায়ক। যেমনটি অভিভাবকের গৃহালয়, শিক্ষার্থীর বোধ ও মেধায় তেমনি আদর্শ শিক্ষক ও তাঁর কর্মস্থল যা তীর্থস্থানসম শিক্ষালয় বা বিদ্যাপীঠ। শিক্ষার্থীদের জন্য শেষকথা- রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চেতনার পরম লক্ষ্য ছাত্র-ছাত্রীরা হবে-‘‘ নিন্দাবিলাসী নয়, পরশ্রীকাতর নয়, অক্ষমকে সাহায্য করতে তারা তৎপর এবং ভালকে তারা ঠিকমতো যাচাই করতে জানে।’’ আগামী দিনের ছাত্ররা প্রকৃতি ও মানব কল্যাণে সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের পূজারী হবে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী-
* রবীন্দ্র জীবন কথা, প্রভাত কুমার মূখোপাধ্যায়, ৪র্থ সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ,কলিকাতা, ৭০০০০৯।
* সার্ধ শতবর্ষের রবীন্দ্রস্মরণ সংখ্যা, ২০১০, পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের মাসিক মুখপত্র, বর্ষ ৪৩, প্রধান সম্পাদক নন্দন রায়।
* চিঠিপত্রে বিদ্যালয় প্রসঙ্গ, সংকলক- গৌরচন্দ্র সাহা, রবীন্দ্র ভবন বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতন, প্রকাশ কাল- ১৪০৭ পৌষ ৭।
* আমার ছেলেবেলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্পাদনা- শিব প্রসাদ, প্রকাশক- কণিকা রায়, শিশু মনন, ১২, নজির আহম্মদ চৌধুরী রোড, চট্টগ্রাম।

লেখক : সাবেক উপাচার্য- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি), পৃষ্ঠপোষক- বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিরিয়ার উপকূলে নৌকাডুবি নিহত বেড়ে ৭৭
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের সময়ের ডাঃ খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুল