দীর্ঘ তেইশ বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আঞ্চলিক, শোষণ, বঞ্চনা, প্রতারণার শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ২৬৬ দিনের অসম যুদ্ধে দুই বৃহৎ শক্তির তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ৫০ বছর আগে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধারা, রাজনীতিবিদরা-এখনো অনেকেই জীবিত আছেন।
বিগত ৫০ বছরে অনেক চড়াই, উতরাই, বৈপরীত্য, বৈষম্য আন্ত ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ৫০ বছরের প্রায় ২৮ বছর স্বাধীনতার চেতনাগুলো, বিসর্জনগুলো আহাজারি করেছে, অপ রাজনীতির নামে, স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালনের আক্রমণে। অন্ধকার, অবাঞ্চিত, অনাকাঙ্ক্ষিত অতীতকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। যারা মনে করেছিল ১৯৭৫ সালের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নির্মম নিধনের মাধ্যমে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেবে, তারা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে, প্রায়শ্চিত্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, বর্তমানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড় করিয়েছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষের আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধকে উঁচুতে তুলে ধরেছেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার সঠিক পথে অদম্য অগ্রযাত্রায় ফিরে এসেছে। মাথাপিছু আয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি, জাতীয় সমৃদ্ধি, রিজার্ভ বেড়েছে। বৈশ্বিক আলোড়নে, অংশগ্রহণে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছে। কাঙ্ক্ষিত সময়ে অগ্রগতির বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জন করে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে এক এক করে সম্পন্ন করে যাচ্ছেন। দীর্ঘজীবী হোন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন তিনি, ক্ষুধার অন্নের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। চিকিৎসা ও আবাসনের নিরাপত্তা দিয়েছেন। বৈশ্বিক মর্যাদা দিয়েছেন। স্বপ্ন জয় করেছেন । গোটা দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে স্বপ্ন জয়ের এক একটি ধাপ ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করে চলেছেন । দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে, সাথে থেকে, সাথে রেখে।
ক্ষুধা-দারিদ্র্য, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনির মাধ্যমে নিরাপত্তা, পশ্চাৎপদতা, কূপমন্ডুকতা, প্রাকৃতিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক সকল প্রকার বৈষম্য ক্রমান্বয়ে নির্মূল করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সারাবিশ্বের উল্লেখযোগ্য নেতা-নেত্রীদের উপরের কাতারের উঠে এসেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সততা, নির্ভীকতা, নির্লোভ মানসিকতা, কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং দেশের মানুষের স্বপ্নের সাথে তাঁর অগ্রযাত্রা মানুষের স্বপ্নকে আলোকিত করেছে, উজ্জ্বল করেছে। বিশ্বের নিপীড়িত, নিগৃহীত, অসহায় মানুষগুলো শেখ হাসিনার জন্য, শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন বোনেন, অহংকার করেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তার অন্যতম প্রমাণ। এমন একটি সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একই ধারাবাহিকতায় তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতার শীর্ষে থেকে দেশসেবা করার প্রত্যয়ে নিবিড়ভাবে যুক্ত পেয়েছি। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যারা সঙ্গ দিচ্ছেন- রাজনীতির সাথে, অর্থনীতির সাথে, প্রশাসনকে এগিয়ে নেয়ার সাথে, তাদের নিয়ে বারবার কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। যা কোনোভবেই এগিয়ে যাওয়া, হার না মানা, অদম্য বাঙালির বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক, দুশ্চিন্তা ও দুরাশার। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমাদের হতাশা বেড়ে যায়। আমরা হতাশ হই। নির্লিপ্ততা অন্যায়। নির্লিপ্ততার সুযোগে একশ্রেণীর প্রশাসক, অপেশাদার আমলা, রাজনীতিক দেশটিকে নিয়ে অসাধু খেলা খেলে যাচ্ছে। প্রশাসনিক ইন্টিগ্রিটি সুরক্ষিত রাখছেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামপ্রতিক কর্মকাণ্ডে কথায় আসতে চাই। এটি একটি মন্ত্রণালয়। রাজনৈতিক প্রধান দুইজন। উত্তরাধিকারের রাজনীতি থেকে উঠে এসে সরকারে যুক্ত আছেন। তাদের পূর্বসূরীর রাজনৈতিক ঐতিহ্য আছে। ইতিহাস আছে। ত্যাগ আছে। তিতিক্ষা আছে। তাদের নিয়ে জাতি, শিক্ষা সম্পৃক্তরা আশাবাদী। মানুষেরা যা আশা করে, তা সামান্য নয়। সংকীর্ণ, সংক্ষিপ্ত নয়। মানুষের আশা পূরণে তাদের এযাবৎকালের কর্মকাণ্ড সন্তোষজনক নয়।
সরকার ক্ষমতায় প্রায় আড়াই বছর। কোভিডকালীন সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে নিয়ে আমাদের পথ চলতে হচ্ছে। এই সময় মন্ত্রী আমলাদের দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেম দেশের মানুষকে আলোকিত, পুলকিত, উজ্জীবিত করতে পারত। মানুষের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে তাদের চলা, বলা, কর্মকাণ্ড, কর্মতৎপরতা, দূরদর্শিতা, নিবেদন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারত। কোভিড বিশ্বমারির বিপর্যয়ে তারা কাঙ্ক্ষিত মানে নিজেদের উঠিয়ে আনতে পারেনি। দেশের মানুষের হতাশা আছে। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট আছে। প্রশাসনিক বাণিজ্যিকীকরণে ক্ষোভ, হতাশা আছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিনরাত ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করছেন। দেশের মানুষের কল্যাণে, দেশের মানুষকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। সংকট, সংশয় দূর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য। স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য।
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোনক্রমেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। এটি কষ্টের। এটি হতাশার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক-কর্মচারী, প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ সংকটে সরকারকে সহযোগিতা করে যাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত, লিপ্ত, সম্পৃক্ত আছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রধানদের নির্লিপ্ততা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত এই মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কিত জনমানুষকে বারবার আশাহত, বিভ্রান্ত করছে। শিক্ষায় যারা সম্পৃক্ত, তারা মর্যাদায় সিক্ত হতে, আপ্লুত হতে সব সময় উম্মুখ থাকেন। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। আত্মসম্মানবোধের বিষয়। চাকরিতে বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োকনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাবোধ, ভেদাভেদ চাকরি জীবনের কর্মক্ষমতা, আন্তরিকতা, কাজের উৎকর্ষতা বাড়িয়ে দেয়। মানুষ অর্থের সাথে, পদ-পদবির সাথে সম্মান এবং মর্যাদাবোধকে লালন করে। এটি মানুষের সহজাত। কর্মে বেঁচে থাকার মানসিকতা লালন করা মানুষের সংখ্যা শিক্ষকতায় বেশি।
দীর্ঘ সময় শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে, বিভিন্ন সাধারণ পদে পদায়ন বদলি থেমেই গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে যেখানে চেতনার বোধগুলোকে জাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বাঙালি জনমানুষ উম্মুখ থাকার কথা, সেখানে অনিয়ম, নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা, অন্যমনস্কতা, অদূরদর্শিতা চরমভাবে, পরমভাবে জেঁকে বসেছিল। যদিও ব্যক্তি তদবির কিংবা ব্যক্তির তৎপরতা ছাড়া এখনও পদায়ন, পোস্টিং হয় না। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এটাই আকাঙ্ক্ষার বিষয়। নিয়ম বা অনিয়ম এখানে মুখ্য বিষয় হয় না। আমলানির্ভর প্রশাসন, রাজনীতি এর জন্য দায়ী বলে অনেকেই মনে করেন।
অতিসমপ্রতি এসবের লকডাউন কাটিয়ে উঠে বিশাল পরিসরে পদোন্নতির প্রক্রিয়া সক্রিয় করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে পদোন্নতি প্রক্রিয়াধীন আছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে মাঠ পর্যায়ের পক্ষ থেকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।
আমরা হয়তো অচিরেই পদোন্নতিহীনতার সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে অভিনন্দন জানাতে পারবো। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে এটি শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত চাকরিজীবীদের আরো আলোকিত, আরো আরো উজ্জীবিত-আপ্লুত করবে।
অতিসমপ্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক পর্যায়ে পদায়ন করা হচ্ছে দীর্ঘ বিরতির পর। এখানে দীর্ঘ নির্লিপ্ততা কাটিয়ে উঠেছে প্রশাসন। এজন্য তাদের সাধুবাদ জানানো যায়।
কিন্তু আমলাতন্ত্র এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতি যদি দেশপ্রেমের ঘাটতিতে পরিচালিত হয়, ক্ষমতা যদি অপচর্চার হাতিয়ার হয়, কথার রাজনীতি যদি সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়, কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশ কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করে না।
এরকম করতে চলতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আহাজারি বেড়ে যায়, আলাপ বিলাপে পরিণত হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রম, দেশপ্রেম, যথার্থভাবে জনগণকে সুফল দিতে যথার্থভাবে সার্থক হয় না, সুযোগ পায় না। গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
নিয়োগের অবস্থা দেখে মনে হয়, এখানে আঞ্চলিকতা কাজ করছে। বিশেষ গোষ্ঠীপ্রীতি কাজ করছে। বিশেষ রাজনৈতিক প্রশাসনিক ব্যক্তির প্রভাব কাজ করছে। দর্শন ও দূরদর্শিতায় চরম ঘাটতি বিরাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীকে অনেক কিছুই জানানো হচ্ছে না এবং দেশকে নিয়ে একটি খেলার অবতারণা করা হয়েছে। দেশে শিক্ষিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করার মানুষের অভাব হয়েছে, এটা বিশ্বাস করা কিংবা চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। একজন মানুষকে তার চাকরির অবসরের মুহূর্তের আগ থেকে, শিক্ষা, প্রজ্ঞা, গবেষণার মানদণ্ডের বিবেচনাবোধ বাদ দিয়ে, কোচিং- প্রাইভেট বাণিজ্যের অনৈতিকতাকে উৎসাহিত করতে নিয়ে এসে প্রশাসনিক পদে যুক্ত করে দেয়ার নাম দেশ প্রেম হতে পারে না। অবশ্য নিকট অতীতে দেশের কোন কোন শিক্ষা বোর্ডে কোচিং সিন্ডিকেটের মহারথীদের পদায়ন করে এরকম অনৈতিকতাকে আগেই উৎসাহিত করা হয়েছে। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এভাবেই শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে পরিণত করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ে পর্যন্ত বিস্তৃত হয় নি আগে। কৃতিত্ব আঞ্চলিক এবং উত্তরাধিকারের রাজনীতি নতুন ধারার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগে উচ্চ শিক্ষার গুরুত্ব সব সময় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। আমরা সমপ্রতি দেখি কি, পিএইচ-ডির মত উচ্চ সনদ না থাকা সত্ত্বেও এই মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে ডক্টর অমুক তমুক লিখে রাষ্ট্রপতির পক্ষে চাকরির বয়স বাড়িয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রথম জনের বেলায়ও বয়সের সমস্যা ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশে যোগ্য লোকের চরম ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপ এরকম কখনোই ছিল না। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা আহত হয়। প্রশাসন মানুষকে আহত করার জন্য প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। এ বোধ মন্ত্রণালয় লালন করবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার মত অনেকেই এটি পোষণ করে।
মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল নির্দেশনায় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে কি তথ্য ভুল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়? তা জানার অধিকার এদেশের মানুষের আছে। ব্যক্তি বিশেষের প্রভাবের খেলা পরিত্যাগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, গোষ্ঠী বিশেষের সন্তুষ্টির জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। অঞ্চল বিশেষের অগ্রাধিকারের জন্যও স্বাধীনতা আসেনি। উত্তরাধিকারের রাজনৈতিক অপচর্চার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়নি অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিচয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং জনগণের মাঝখানে সেতুবন্ধন হিসেবে যারা কাজ করার দায়িত্ব প্রাপ্ত, তাদের সন্তুষ্টির জন্য দেশটি রক্তগঙ্গা পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। প্রিয় মাতৃভূমির চেতনাকে ব্যক্তিবিশেষের চেতনায় রূপান্তরিত করে, দেশকে নিয়ে এসব খেলা পরিহার করা দরকার। এটাই আমরা কামনা করি।
শীর্ষ আমলাদের পারিবারিক সুবিধার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দেশটিকেতো সুশাসন অর্জন করতে হবে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অঙ্গীকার। স্বজনের-পরিজনের দ্বারা শাসন-প্রশাসনের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
দেশের বোঝা বাড়িয়ে চলা একশ্রেণীর বর্তমান বা সাবেক আমলা কিংবা রাজনীতিকের অদূরদর্শী চেতনার লক্ষ-উদ্দেশ্য হতে পারে না দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এভাবে দেশ পরিচালনার নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পাশ কাটানো বা তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করা অনুচিত। পরিহার করতে হবে।
অতিসমপ্রতি অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ঘটনায় আমলাদের উর্বরতা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিছু দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ সতর্ক না হলে, সচেতন না হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বোঝা আরো বেশি বেড়ে যেত। আমলার মামলা থেকে দেশপ্রেমিক জনগণকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশীদারদের সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আরও বেশি বিভ্রান্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরের, মর্মান্তিক পঁচাত্তরের আগে পরের, ছিয়ানব্বই এর আগে পরের, ২০০১ এর আগে-পরের এবং সর্বশেষ ২০০৯ এর আগে পরের আমলা চরিত্র এদেশের মানুষের জানা আছে।
আমাদের একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তিন লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছিল। ৩০ লাখ প্রাণের বিসর্জন ঘটেছিল। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক দেশ আছে, যারা এক সাগরের রক্তের বিনিময়ে, অসম যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।
আমলারা যুদ্ধ করেনি। দু’একজন ছাড়া মন্ত্রীরাও না। বিশেষ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত আজকের গোষ্ঠী প্রতিনিধিরাও যুদ্ধ করেনি। এমনকি তাদের পূর্বপুরুষরাও না। তাহলে কেন এত গোষ্ঠীপ্রীতি ও টানাটানি? মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসরমান বাংলাদেশের উপর তারা বার বার বোঝা হয়ে চড়ে বসেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে নিয়ে যেভাবে কাজ করেন, স্বপ্ন দেখেন, চিন্তা করেন -তাঁকে সঙ্গ দেয়ার, সহযোগিতা করার আমলা মন্ত্রীদের সংখ্যা নেহায়েত কম। মন্ত্রীদের মনঃসংযোগ নিবিড় ভাবে এদিকে থাকা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপর থেকে বোঝা কমানোর প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত দেশপ্রেমিকের সংখ্যা একেবারেই কম।
যদি গোষ্ঠী বিশেষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সুবিধায় রূপান্তরিত করে, তা নিয়ে টানাহেঁচড়া করে অনৈতিক সুবিধা নিতে চায়, তাহলে ৩০ লাখ শহীদের সাথে চরম প্রতারণা করা হবে। আমাদের মন্ত্রী মিনিস্টারদের সঠিক ট্রেকে ফিরে আসতে হবে। ঘাটতি দূর করতে হবে। দেশপ্রেমের যে ঘাটতিগুলো নিয়ে তারা রাজনীতি করে বেড়াচ্ছেন, তা সেলফ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে পূরণ করে ফেলতে হবে। জনগণ বেশিদিন অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতাকে মুখ বুঝে সহ্য করবে না।
বঙ্গবন্ধুর কথাকে ঘুরিয়ে বললে যেভাবে বলা যায়, ‘আমরা যখন প্রতারণার শিকার হচ্ছি তখন আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখাটা খুব সহজ হবে না।’ বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী, সততা সর্বোত্তম সত্তা শেখ হাসিনা যখন জনগণের সাথেই আছেন, তখন প্রতারিত, বঞ্চিত জনগণের ভয়ের কিছুই নেই।
আমরা বিশ্বাস করি, চেতনার বয়স নেই, মৃত্যু নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যতই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হোক, উত্তরাধিকারের পরিচয়ে বা ক্ষমতার পরিচয়ে কিংবা অন্যান্য পরিচয়ে, সেটি টেকসই হবে না, টিকবে না।
আমরা গত ২১ শে পদকে দেখেছি, আমলার মামলা, হামলার নির্লজ্জ প্রভাব। দেশের ৩০ লাখ শহীদের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এসব প্রতারণা। এসব প্রতারণা আমরা আর দেখতে চাই না।
অসত্যকে, অসাধুতাকে, অনিয়মকে, অপকর্মকে সাময়িকভাবে আলো দিয়ে, জ্বালানি দিয়ে আলোকিত করা যায়। এতে সত্য, ন্যায়নিষ্ঠতা বিভ্রান্ত হয় সাময়িকভাবে। এটি খুবই সাময়িক। সময়ের ব্যবধানে অসত্য, অনিয়ম নিশ্চিহ্ন হয়ে ভেসে যেতে বাধ্য। যারা রাজনীতি করে তাদের প্রয়োজনেই এই উপলব্ধি জাগিয়ে রাখা দরকার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক এসব অপকর্মকাণ্ডের কথা শুনে আপ্লুত হবেন, বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব কথা পৌঁছাবেনা, আমলা রাজনীতিকদের এমন বিশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই। নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের খেলা, গোষ্ঠীর খেলা, আঞ্চলিকতার খেলা পরিহার করলে ব্যক্তির উৎকর্ষ সাধিত হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। দেশটি এগিয়ে যাবে।
এ প্রত্যাশা অতিআশা নয়, এটি আমরা সব সময় লালন করি। সংশ্লিষ্ট সকলে ভাল থাকুন। দেশের চেতনার আলোচিত পথে হাঁটুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করুন। স্বপ্নজয়ী বাংলাদেশকে স্বপ্ন পূরণের প্রান্তে নিয়ে যেতে সাথী হোন। সঙ্গী হোন। মননের অন্ধকারকে দূর করুন। স্বজনপ্রীতিকে পিছনে রাখুন। গোষ্ঠীপ্রীতিকে বর্জন করুন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রধান সমন্বয়ক, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।
মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর- ১১