২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। এই শিক্ষাক্রম হলো যোগ্যতা ভিত্তিক। এতে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে যোগ্যতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি হওয়ায় এর সফলতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই শিক্ষাক্রম চালুর আগে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা, বাস্তবায়নের অবস্থা যাচাই ও চাহিদা নিরুপণ সমীক্ষা করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০১৯ সালের ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে যোগ্যতা ভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু আছে, বিশ্বের এমন বেশ কিছু দেশের শিক্ষক–শিক্ষার্থীর তুলনাসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। তখন দেশে মাধ্যমিক স্তরে ৪২ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক ছিলেন। নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর দেখা যায় মাধ্যমিকে ৩৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। তবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৫২ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক। শুধু তাই নয়, কোনও কোনও বিদ্যালয়ে একেকটি শ্রেণিকক্ষে ৬০–৭০ শিক্ষার্থী নিয়েও শিক্ষকদের ক্লাস করতে হয়। অথচ ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুযায়ী,২০১৮ সালের মধ্যে মাধ্যমিকে গড়ে প্রতি ৩০ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষকের ব্যবস্থা করার কথা, কিন্তু তা হয়নি। একই অবস্থা প্রাথমিকেও গড়ে ৩৮ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন।
এনসিটিবি সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে দেখা যায় যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম থাকা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১২ শিক্ষার্থীর জন্য এক জন, থাইল্যান্ডে ২৪ শিক্ষার্থীর জন্য এক জন, ইন্দোনেশিয়ায় ১৫ শিক্ষার্থীর জন্য একজন, কম্বোডিয়ায় ২৯ শিক্ষার্থীর জন্য একজন,অস্ট্রেলিয়ায় ৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন, ফিনল্যান্ডে ১৩ শিক্ষার্থীর জন্য একজন ও ডেনমার্কে ১১ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। অন্যদিকে ভারতে ২৮ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে এক জন শিক্ষক।
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পর্যাপ্ত শিক্ষক যেমন দরকার, তেমনি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দক্ষতাও দরকার। মনে রাখতে হবে, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এর সাথে শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি পদোন্নতির ব্যবস্থাও রাখতে হবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। এরপর চালু হবে উচ্চমাধ্যমিকে। আগামী বছর থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন বিষয় পড়ানো হবে। শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চ মাধ্যমিকে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীনে দুটি পরীক্ষা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রায় সব শ্রেণিতেই বড় অংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীনের ভিত্তিতে। তবে অনেকের অভিমত, ক্লাসগুলোতে পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান অর্জনে ঘাটতি দেখা দিবে। শিক্ষার্থী স্কুলে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ঘাটতি দেখা দিবে এবং এতে পরীক্ষার প্রতি ভীতি তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে ২০ হাজার ৯৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে) মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হয়। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাত্র ৬৮৪টি। সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ জন। মোট শিক্ষক আছেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৮ জন। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংকটের মধ্যেও প্রায় দেড় শ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরও পড়ানো হচ্ছে। এরজন্য শিক্ষকদের কোনও আলাদা প্রশিক্ষণ করানো হচ্ছে না। শুধু প্রাথমিক স্তরে নয়, একই শিক্ষক দিয়ে কয়েকটি বিদ্যালয়ে আবার উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতেও পড়ানো হচ্ছে। ফলে শিক্ষক সংকটটি আরও তীব্র হয়েছে। মাউশির সূত্রমতে, বর্তমানে সহকারী শিক্ষকের ১ হাজার ৮১৭টি পদ শূন্য।
এদিকে ১১ জুলাই থেকে প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন শুরু করেন বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা। ১৬ জুলাই থেকে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। তাঁদের দাবি মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, যাতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সমান বেতন ভাতা ও পেনশন সুবিধা পান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময় শিক্ষকরা যদি টিকতে না পারেন, তাহলে তাঁরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন কীভাবে। শিক্ষকদের দাবি মূলত তিনটি বিষয়ে বৈষম্যের। যেখানে সরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বেতনের ৪৫%, সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ১০০০ টাকা। বেতনের ১০০% উৎসব ভাতা পান সরকারি শিক্ষকেরা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ২৫%।চিকিৎসা ভাতা এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র ৫০০ টাকা,সরকারি শিক্ষকেরা পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কোনও পেনশন সুবিধা নেই। প্রশ্ন হলো শিক্ষকদের বেতন, ভাতা বা জাতীয়করণের জন্য আন্দোলন করতে হবে কেন? তারা তো জাতিকে শিক্ষিত করার কাজে নিয়োজিত। সরকার জনগণকে যে মৌলিক অধিকারটি দিতে পারছে না সেটি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন শিক্ষকরা। বরঞ্চ তাদের কাছেই সব সুযোগ সুবিধা পৌঁছানো সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আগেই বলেছি শিক্ষা জনগণের মৌলিক অধিকার এবং সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সে বিবেচনায় গ্রাম মফস্বলের সব স্কুল, যেখানে শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, সেগুলোর অর্থায়ন সরকারকে করতেই হবে। কারণ সরকারি স্কুলে এক কোটি ছাত্রের মাত্র ৫–৬% পড়ে। বাকী শিক্ষার্থীর শিক্ষায় দায়িত্ব বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর উপর।
দেখা যায়, বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ছাত্র বেতন দিয়ে শিক্ষকদের বেতন মেটানো অসম্ভব। তাই এ রকম সব স্কুল সরকারিকরণ করতে হবে। এমপিওভুক্তিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করতে হবে। বর্তমানে ১৭ হাজার ৬১৪টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮২১ জন শিক্ষক এমপিওর সুবিধা পান। কিন্তু এমপিওভুক্ত নয়, এমন স্কুলগুলোতে যে ৩৩ হাজার ৪০৪ জন শিক্ষক আছেন, তাঁদের অবস্থা ভয়াবহ। এসব শিক্ষকদের মাসিক বেতন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এই বেতন দিতে গিয়েও স্কুলগুলোর অবস্থা কাহিল। সরকার থেকে এ বাবদ একটি টাকাও দেওয়া হয় না। এই স্কুল গুলোর অবস্থা ‘দিন আনি দিন খাই’।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা যদি ‘আধপেটা’ অবস্থায় থেকে থাকেন, তবে এই শিক্ষকেরা আছেন ‘অনাহারে’। তাঁরা আছেন, কারণ আর কোনো সুযোগ নেই তাঁদের। যারা একটু ভালো শিক্ষক, তাঁরা সুযোগ পেলে অন্যত্র চলে যান। এই ৩৩ হাজার শিক্ষককে এমপিওর আওতায় নিয়ে আসতে বার্ষিক আনুমানিক ব্যয় হবে ৫০০ কোটি টাকা। ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেটে এই অর্থ খুবই নগণ্য। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী জিডিপির অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে ব্যয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সবার পেছনে (২.১%) (এর একটা বড় অংশ আবার ভৌত অবকাঠামোতে ব্যয় হয়)। এমনকি নেপাল(৪.২%), ভিয়েতনাম (৪.১%) ও পাকিস্তানের (২.৪%) অবস্থানও আমাদের চেয়ে ভালো।
মনে রাখতে হবে, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ আমরা অবলীলায় মওকুফ করতে পারি সেখানে শিক্ষা খাতে অতিরিক্ত ৫০০–১০০০ কোটি টাকা খরচ করা কোন বিষয়ই না। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের সিরিয়াসলি ভেবে দেখা উচিত। কারণ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ কখনো বিফলে যায় না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট