ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক। তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তিনি বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি কলকাতার একটি পাঠশালা এবং পরে সংস্কৃত কলেজে থেকে তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায় তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পণ্ডিতের পদ লাভ করেন। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি কলেজের অনেক সংস্কার করেন। ইতিপূর্বে এ কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের পড়ার সুযোগ করে দেন। প্রতিপদ ও অষ্টমীর বদলে রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি চালু করেন। বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র একজন শিক্ষাসংস্কারক নন, সমাজ সংস্কারক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় যেমন ‘সতীদাহ প্রথা’ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তেমনই বিদ্যাসাগরও বাল্যবিবাহ ও কৌলিন্য প্রথা বন্ধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের শত বাধা অতিক্রম করে তিনি বড় লাটের সহায়তায় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাস করালেন ও প্রবর্তন করলেন। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে।
সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। বর্ণপরিচয় (১৮৫১) প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্যে এ রকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থটি বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিলো। বর্ণপরিচয়ের মতো সমান সাফল্য লাভ করেছিল ‘বোধোদ’ (১৮৫১), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘চরিতাবলী’ (১৮৫৬) এবং ‘জীবনচরিত’ (১৮৫৯)। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও (১৮৫১) বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব এর আগে বাংলা ভাষায় কোনো প্রকাশনা ছিলো না। চার খণ্ডে লেখা ‘ব্যাকরণ-কৌমুদী’ও (১৮৫৩-৬৩) তাঁর ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।