ছন্দা চক্রবর্তী
পানি এক হওয়া সত্ত্বেও করলা তিক্ত, মরিচ ঝাল আর আখ মিষ্টি হয়, এটা পানির কারণে নয়, বীজের কারণে হয়। ঠিক তেমনিই মানুষ সব এক হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা ও সংস্কারের কারণে, একে অপরের থেকে ভিন্ন হয়। এই প্রবাদ লাইন দ্বারা বোঝা যায়, শিক্ষা ও সংস্কারই মানুষ প্রজাতির মানুষ হয়ে উঠার বীজ বা উৎস শিক্ষা ও সংস্কার নিয়ে মানুষ আপন আপন সামর্থানুযায়ী গড়ে উঠে। এক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতিরও একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। তাইতো ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের, ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারের প্রভাবে আলাদা রকম হয়। শুধু সংস্কার নয় শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণের তারতম্যের কারণেও ভিন্ন ধরনের মানুষের সৃষ্টি হয়। তবে যে যত জ্ঞানী বা মুর্খ, বুদ্ধিমান বা বোকা যাই হোক না কেন; তাকে শিক্ষা গ্রহণ করে করেই মানুষ হতে হয়। কেউ হয় সত্যিকারের মানুষ আর কেউ বা হয়ে যায় মুখোশ পরা মানুষ বা অমানুষ। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘মানুষের প্রধান কর্তব্য, তাকে এমনটিই হতে হবে যাতে তাকে মানুষ বলে দেখতে পাওয়া যায়। এ কর্তব্য শুধু তার নিজের সুবিধের জন্য নয়, পরের দায়িত্বের জন্যও’।
আমরা বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত। হাজার বছরের অতীতকে নিয়েই বাঙালি সংস্কারের পথচলা। অতীতের জীবন্ত চর্চাগুলোই পরের কালের অর্থাৎ বর্তমানের ঐতিহ্য। দিন যায়, সময় গড়ায়, বাঙালি জাতির গর্বের আলোকময় ঐতিহ্য ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, এবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। কালের প্রবর্তনে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক এর জন্য এখন অতীতের জীবন্ত চর্চাগুলিই শিক্ষা ও সংস্কারের মধ্যে অন্যতম। তাই বাঙালি জাতির প্রধানতম সংস্কার বাংলার মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বর্তমান মাইলফলক, ৫২ এর ৭১ বছর ও ৭১ এর ৫২ বছর । স্বাধীনতার ৫২ বছরে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির সংস্কার হোক অতীতের এই গৌরবগাথা নিয়ে, শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণ, হোক ৫২ ও ৭১ এর সংস্কার কেন্দ্রিক তথা হৃদয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ, ও আদর্শে বঙ্গবন্ধু, এটাই বাঙালি জাতির চির উন্নত সংস্কার ও শিক্ষা হওয়ায় কাম্য।
সংস্কার থেকে সংস্কৃতির সৃষ্টি। সংস্কৃতি পালনের বিষয়, চর্চার বিষয়। সংস্কৃতি ও শিক্ষা পরষ্পর অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। চিরাচরিত সংস্কারগুলি যা সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে সেসব পালন করতে করতে একটা শিক্ষা আয়ত্তে এসে যায়। আবার শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা যখন অন্যজন গ্রহণ করছে, সেই গৃহীত শিক্ষা যখন প্রায়োগিক ব্যবহার হয়, এবং এই প্রায়োগিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ব্যাপারটাই সংস্কৃতি বা কালচার হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখাটা বেশি প্রাসঙ্গিক, ‘কমল–হীরের পাথরটাকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।’ অর্থাৎ দীপ্তিহীন পাথরের কোনো মূল্য নেই। তেমনি যে শিক্ষাতে কোনো আলো নেই, সেই শিক্ষাও মূল্যহীন। বর্তমান প্রজন্মকে আমরা শুধু শিক্ষাতে ভারী করে তোলার প্রয়াস চালাচ্ছি, দীপ্তি সৃষ্টির উপযোগী করে শিক্ষা প্রদান করছি না। এর অনেক কারণের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক পারিপার্শ্বিক, প্রাতিষ্ঠানিক একাডেমিক, মোবাইল নির্ভরতা ইত্যাদি কারণ ছাড়াও একটা বড় কারণ হলো যে কোনো রকমের বই পড়ার প্রতি অনীহা অর্থাৎ পাঠাভ্যাস হ্রাস পাওয়া। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় পর্যবেক্ষণিক দৃষ্টিতে দেখেছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সিলেবাস ভুক্ত পড়াসমুহও নিজেরা পড়ে আত্মস্ত করে না, এবং নিজেরা পড়ে নোটসও তৈরি করে না, তাদের অতো ধৈর্য বা সময় কোনোটায় নেই, তারা সরাসরি গাইড বই এবং কোচিং থেকে প্রাপ্ত সীট মুখস্থ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করে, কিছু শিক্ষার্থী ব্যতিক্রম হয়তো আছে তবে এসংখ্যা হাতে গোনা। তার একটি বড় প্রমাণ হলো, দেশের প্রান্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ, তথা একাদশ–দ্বাদশ বা কিছু কিছু স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থীকেও জাতীয় দিবসগুলি কোনটি কিসের জন্য প্রশ্ন করা হলে সঠিক উত্তর পাওয়া দুর্লভ হয়।
কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা, সংস্কার নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে তৈরি করতে গেলে পাঠাভ্যাসে মনোযোগী, ধৈর্যশীল প্রজন্ম সৃষ্টির বিকল্প নেই। কারণ আমরা তো জানি, জগতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নীতি, আদর্শ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক জ্ঞান এসব, বই পড়ুয়া ব্যক্তিদের পাঠাভ্যাসের ফলে আয়ত্ত করা যায়। একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন কিন্তু বই এর প্রকাশনা শিল্প, অনেক উন্নত এবং চারদিকে বই এর বেচা কেনাও অনেক বেশি, কিন্তু সত্যিকারের বই–পড়ুয়ার অনেক অভাব। সাধারণ মানুষ বই কিন্তু কেনেন, এটা সমাজের উত্তোরণ, অবশ্যই একটা ভালো দিক, হয়তো বা লোক দেখানোও হতে পারে, তবে তাও ভালো। আমরা আশা করতেই পারি, ফুল নাড়তে নাড়তে যেমন ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে যেমন গন্ধ বের হয় তেমনি বই কিনতে কিনতে বর্তমান প্রজন্ম পড়ুয়া হয়ে উঠবে। সেই জন্য বইকে যাঁরা সহজলভ্য, সহজপ্রাপ্য এবং সুলভ মূল্যে যোগান দিচ্ছেন তারা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
গবেষণায় পাওয়া যায়, বই যারা নিয়মিত পড়ে তাঁদের অন্তর্চক্ষু খুলে যায়, জীবনীশক্তি বাড়ে, মনের ক্ষুধা মেটায়, বই মানুষের মনকে শীতল রাখে, মস্তিষ্ককে সচল রাখে, বিষণ্নতা দূর করে, জ্ঞান বাড়ে, এবং সর্বোপরি শিক্ষা ও সংস্কারে সমৃদ্ধ করে তোলে। স্বাধীনতা প্রাপ্তিরদশকে বই কেনাটা অনেকটা ভাগ্যের ওপর ছিল, কিন্তু ধার করে, সংগ্রহ করে, আনা হতো বলে পড়ার আগ্রহটা মনে হয় একটু বেশি থাকতো। কারণ সদ্য স্বাধীন দেশের বেশির ভাগ নাগরিক তখন শুধু খেয়ে–পরে আর কোনো রকমে স্কুলের বই যোগাড় করেই পড়াশোনাটা চালাতো। সেখানে প্রচলিত শব্দ আউটবুক কেনা ছিল বিলাসিতা। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক ‘সৈয়দ মুজতবা আলী’এর বই কেনা বিষয়ক রম্য লেখার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল ‘পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের এক চোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত ঘোঁত করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুললেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কি? প্রথমত বই পড়া, এবং তার জন্য দরকার বই কেনার প্রস্তুতি।’
বর্তমান বাংলাদেশ এখন সেই দারিদ্র সীমা পার করেছে অনেক আগে। বর্তমান প্রজন্মকে ৫২ ও ৭১ এর সংস্কার জনিত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গেলে তাদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়েই করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পাঠাভ্যাসের ফলে তারা নিজেদের ভাষা অর্জনের ঐতিহ্যজনিত ইতিহাস, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, এদেশের ত্রিশ লাখ শহিদের জীবনদান, তিন লাখ মা–বোনের নির্যাতন এবং বাংলাদেশের জন্ম, পাকিস্তানি হায়েনাদের প্রতি ঘৃণা এসব বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। কেননা কারো মুখ থেকে শোনার চেয়ে সে যখন পড়ে জানবে এবং শিখবে, শিখা মানেই যুক্তির সাথে মেনে নেওয়া। আর এই মেনে নেওয়া যুক্তিকে যাচাই করে গ্রহণ করার নাম জ্ঞান। শিক্ষা ও সংস্কার পালন জ্ঞানের উপরই নির্ভরশীল।
গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রচুর তথ্য থেকে জ্ঞান বের হয়, তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তুরিত করতে হয়, জ্ঞান হচ্ছে মহাসত্য কিন্তু নীরস তাই সকলের কাছে পৌঁছায় না, হালকা পাঠে তাকে উদ্ধার করা যায় না। লেখকবৃন্দ জ্ঞানকে পাঠকের কাছে পোঁছে দেওয়ার জন্য সাহিত্যের আশ্রয় নিয়ে গদ্য বা কাব্য রসাশ্রিত মনোমুগ্ধকর কাহিনীকে আশ্রয় করে আবর্তিত হয়, ফলে পাঠকের মন কাঁড়ে, পাঠক গ্রহণ করে। মনোযোগী পাঠক ধীরে পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়। পাঠাভ্যাসের ক্ষুধাও বাড়ে, আর তাই তো বই পড়ে পড়ে মানুষ জ্ঞানী হয় এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তিগত জ্ঞানে সমৃদ্ধ এটা ঠিক, তাদের কাছে প্রচুর তথ্য রয়েছে, তথ্য থাকলেই জ্ঞান হয় না, আবার জ্ঞান থাকলেই অন্তর্দৃষ্টি আসে না। গবেষকদের মতে ‘অধ্যাপক দেন তথ্য, পণ্ডিত দেন ব্যাখ্যা, গুরু দেন অন্তর্দৃষ্টি। আর অন্তর্দৃষ্টির জন্য লাগে সান্নিধ্য, লাগে নিষ্ঠা,লাগে একাগ্রতা’। সেক্ষেত্রে মনোযোগী পাঠাভ্যাসে সান্নিধ্য, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা সৃষ্টির ক্ষমতা বাড়ায়। তবে তথ্য ও জ্ঞান দুটি ভিন্ন বিষয়। তথ্যের ভিত্তিতেই জ্ঞান হয় একথাও ঠিক,কিন্তু তথ্য হচ্ছে এক গাদা মনে রাখার মতো খুঁটিনাটি বিষয়। আর জ্ঞান হচ্ছে, একটা সার্বিক অনুভূতির মতো, যা মনকে সমৃদ্ধ করে। মাদার তেরেসার মতে ‘জ্ঞানের কথা সহজ ও আকারে ছোট হয়, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি হয় সুদীর্ঘ।’ আশার কথা হলো শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের করণীয় বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে অবসর সময়ে সৃজনশীল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার একটি নির্দেশনা রয়েছে। তাই হয়তো আশা করা যায়, বর্তমান প্রজন্ম বই পড়া ও পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা পাঠাভ্যাসে অভ্যস্থ হোক, বই পড়ুক, জ্ঞানী হয়ে উঠুক, আমাদের চিরাচরিত দেশপ্রেমের চেতনা ৫২ ও ৭১ নিয়ে বেড়ে উঠুক, শিক্ষা গ্রহণ, শিক্ষা প্রদান সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কারে আত্মপ্রত্যয়ী হলেই বঙ্গবন্ধুর উন্নত সমৃদ্ধ দেশ স্মার্ট বাংলাদেশ তথা সোনার বাংলাদেশ হয়েই গড়ে উঠবে। নির্বাচিত নতুন সরকার ও নতুন দায়িত্ব পাওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বর্তমান প্রজন্মকে শিক্ষা ও সংস্কারে ঋদ্ধ করে তোলার প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টায় মনোযোগী ও আন্তরিক থাকবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক।