শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদেরকে বেত্রাঘাত করা যাবে না, নির্দয়ভাবে পেটানো যাবে না–এমন একটা আইন হয়তো দেশে আছে। কিন্তু কে মানছে এই আইন? দেশের প্রায় হেফজখানা–এতিমখানায় শিক্ষার্থীদেরকে নির্দয় ও নির্মমভাবে প্রহার করার ঘটনা ঘটছে। মাঝে মধ্যে তা গণমাধ্যমের খবর হিসেবে উঠে আসছে। কিন্তু বিদ্যমান আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। এই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অবুঝ শিশু–কিশোররা পড়াশোনা করছে খুব ভীতিজনক আতঙ্কময় পরিবেশে। তারা না পারছে শিক্ষাঙ্গন ছাড়তে। না পারছে নিজেদের অভিযোগ–আর্তনাদের কোনো সুরাহা করতে। দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে এতিমখানা–হেফজখানাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে মূর্তিমান আতংক হয়ে উঠছে। গত ৮ মে বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদীর শেষ পাতায় প্রকাশিত ছোট্ট একটি নিউজে চোখ আটকে গেল। অনেকেই তা পড়ে নিশ্চয়ই স্তম্ভিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু প্রতিকার কোথায়? দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম-‘থানায় অভিযোগ, হেফজখানায় শিক্ষকের অমানবিক বেত্রাঘাতে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী।’
হেফজখানা ও এতিমখানায় শিক্ষার্থীদেরকে কথায় কথায় বেধড়ক পেটানো কোনো নতুন খবর নয়। এটি কম–বেশি সারা দেশেই চলে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর হাফেজ সাহেব বা শিক্ষকরা বেত্রাঘাত ছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানো সম্ভব তা মানতেই চান না। তারা মনে করেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সময়মতো পড়া আদায়ে প্রহার বা বেত্রাঘাতই একমাত্র উপায়। অথচ এটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। কোনো শিশুর মাঝে বেত্রাঘাতের আতংক ও ভীতি ঢুকে পড়লে তার পক্ষে স্বাভাবিক নিয়মমাফিক পড়াশোনায় মন দেওয়া সম্ভব নয়–এটি শিক্ষকরা উপলব্ধি করতে চান না বলেই বেত্রাঘাতকে একমাত্র সমাধান মনে করেন তাঁরা।
শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা হতে হবে আনন্দপূর্ণ পরিবেশে। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পড়াতে হবে যাতে তারা আনন্দ পায়। দেশের কিন্ডার গার্টেনগুলোর বেশির ভাগ এখন এই নিয়ম–পদ্ধতি অনুসরণ করে সুফল পাচ্ছে। তবে কিছু সরকারি–বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো বেত্রাঘাতের প্রবণতা চলে আসছে। হেফজখানা, এতিমখানা বা প্রাথমিকস্তরের শিক্ষাঙ্গনগুলোকে ‘বেত্রাঘাতের ভীতিজনক পরিস্থিতি’ থেকে বেরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে পাঠদানের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে ‘নির্দয় বেত্রাঘাতের’ কোনো প্রয়োজনই হবে না–তা যেন শিক্ষকরা মাথায় রাখেন।
হেফজখানা এতিমখানা বা প্রাথমিকস্তরের শিক্ষাঙ্গনগুলোর শিক্ষার্থীরা দিনে কতটুকু পড়াশোনা আয়ত্ত করতে পারবে, কতটা পড়া–পাঠ তারা আত্মস্থ ও হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে–তাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। স্বাভাবিক পড়ার চেয়ে বেশি পড়া চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা থামাতে হবে। বিশেষ করে বেশির ভাগ হেফজখানার শিক্ষকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দিনে–রাতে যতটুকু পড়া তাঁরা শিক্ষার্থীদের দেন, ততটা চাপ সামলানো সব শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। সব শিক্ষার্থী সমান প্রতিভা ও মেধাসম্পন্ন হয় না। কেউ খুব মেধাবী, আবার কেউ কম মনোযোগী। তা শিক্ষককে বিবেচনায় রাখতে হবে। কোন্ শিক্ষার্থী কতোটা পড়া আত্মস্থ করতে পারবে, তা মাথায় রেখে সেভাবে স্বাভাবিক পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব একজন শিক্ষকের। শিশু শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ তথা মনস্তত্ত্ব বুঝে সেভাবে পড়াশোনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারলে তখন আর নির্দয় বেত্রাঘাতের প্রয়োজন হবে না।
হেফজখানা–এতিমখানা, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সকল স্তরের শিক্ষাঙ্গনে বেত্রাঘাতমুক্ত মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এজন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। অতীব দুঃখজনক যে, গ্রামের কিছু অভিভাবক ও পিতা–মাতা সন্তানদের ‘মানুষ’ করার জন্য শিক্ষকদেরকে প্ররোচিত করে বলেন, ‘আমার সন্তানের গায়ের চামড়া আপনার। হাড্ডিটা আমার।’ যতো খুশি পিটিয়ে সন্তানকে ‘মানুষ’ করায় প্ররোচিত করা এ কেমন নির্দয় অভিপ্রায় কিছু মাতা–পিতার! শিক্ষার্থীদেরকে অমানবিক বেত্রাঘাত থেকে রেহাই দিতে বিদ্যমান আইনকে ঢেলে সাজিয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক