শিক্ষার্থীদের ড্রেস পড়ে স্কুলে যাওয়ার নিয়ম অনেক আগে থেকে চালু আছে। স্কুল ড্রেসের সুফল বা ভালো দিক অনেক। একেক স্কুলের ড্রেস একেক রকম। ড্রেস দেখে বুঝা যায় কোন স্কুলের শিক্ষার্থী। স্কুল ড্রেসে ছাত্র–ছাত্রীদের অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখায়। এতে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে সুবিধা হয়। শিক্ষার্থীরা সহজে বাধার সম্মুখীন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। যানবাহনে অনেকে বসার সুযোগ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা কি করে তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌছাবে সে চেষ্টায় থাকে। ঘন্টা পড়ার আগে স্কুলে ঢুকতে হয়। স্কুল ড্রেসে একই স্কুলের ছাত্র বা ছাত্রীদের একই রকম মনে হয়। সহজে একজন থেকে আরেকজনকে আলাদা করা যায় না। স্কুলের ড্রেস পড়ার পর শিক্ষার্থীর মনোভাবেও একধরনের পরিবর্তন আসে। স্কুলে যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। সহপাঠীদের সাথে শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে থাকে। একই রকম ড্রেস শিক্ষার্থীদের মন মানসিকতাকেও অভিন্ন করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। কলেজে শিক্ষার্থীদের ড্রেসের কোন বাধ্য বাধকতা ছিলনা। তবে সবাই মার্জিত ড্রেস পড়ে কলেজে আসতো। তারুণ্যের কারণে সহজে বুঝা যেতো এরা কলেজ ছাত্র–ছাত্রী। পরবর্তীতে ছাত্রীদের জন্য কোন কোন কলেজ এ্যাপরন জাতীয় একটা ড্রেস পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি কার্যকর করতে কয়েক বছর লেগে যায়। তারপর প্রায় সব কলেজে ছাত্রীদের জন্য সাদা রঙের একটি এ্যাপরন সুনির্দিষ্ট করে দেয়। গার্লস কলেজে সাদা সেলোয়ার, কামিজ ও সাদা ওড়না পড়ার নিয়ম চালু থাকলে এ্যাপরণ পড়া অনুসরণ করে। এতে করে মেয়েরা সেলোয়ার কামিজ ফ্যান্ট সার্ট বা শাড়ি যা পড়ুক না তার ওপর দিয়ে একটা এ্যাপরন পড়তে হয়।এটাতে কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের ভালোই দেখায়, কলেজের একটা মনোগ্রামও এর উপর লাগানো থাকে। এর ভালো দিক হলো মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য এরকম একটা ড্রেস প্রয়োজন আছে। কারণ ছেলেরা যত সহজে চলাফেরা করতে পারে মেয়েরা ততো সহজে পারে না। বের হলে নানা রকম বাধা আসে। বিশেষ করে কলেজ আসা যাওয়ার পথে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে বৈরী মনোভাব কখনো দেখা যেতো না। তাদের মাঝে সৌহার্দপূর্ণ এবং সহমর্মিতার সহ অবস্থান লক্ষ্য করা যেতো। পরস্পরে প্রতি সহনশীল আচরণ বিরাজ করতো। সহপাঠি ছাত্ররা ছাত্রীদের সাথে সংযত হয়ে কথা বলতো। কখনো উদ্ধত আচরণ করতোনা। সিনিয়রররাও মেয়েদের সম্মান দিয়ে কথা বলতো। কোনো ছাত্রীকে কখনো অপমান করার কথা শোনা যেতো না। লাঞ্ছিত করারতো প্রশ্নই উঠে না। সেসময় মেয়েরা মাথায় তেমন একটা কাপড় দিতো না। সেলোয়ার কামিজ বা শাড়ি যা পড়ুক না কেন মাথা খোলা থাকতো। ওড়না বা স্কার্ফ কোনটা দিয়ে চুল ঢেকে রাখতো না। হিজাব পড়ার কথা কেউ ভাবতে পারতো না। এরকম কিছু আছে বলে মেয়েদের জানাও ছিল না। তারা খুব নির্বিঘ্নে কলেজে চলাফেরা করতো। ক্লাসে আলাদা বেঞ্চে বসে মনোযোগ দিয়ে টিচারের লেকচার শুনতো। ক্লাস না থাকলে কমনরুমে গিয়ে গল্পগুজব করতো। ছেলেদের সাথেও এটা সেটা নিয়ে আলাপ হতো। তবে মেয়েদের আলাদা কমনরুম ছিলো। সেখানে তারা অধিকতর স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো। কেউ কখনো ক্লাস ফাঁকি দিতো না। লেখাপড়ার মাঝে সবাই নিজেদের ব্যস্ত রাখতো। আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে কলেজের সময়টা কেটে যেতো।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র–ছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলন–সংগ্রাম দুর্বার গণ–আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। জাতির যে কোন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র–ছাত্রীরা এগিয়ে এসেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছে, জাগিয়ে তুলেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররা সবার আগে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্র–ছাত্রীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সর্বজন বিধিত। দেশে সামরিক শাসন জারী থাকলেও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীরা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছে। আইয়ুব বিরোধী সংগ্রাম ও ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময় সারা দেশ উত্তাল ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জেল জুলুম হত্যার মধ্য দিয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও ছাত্র–ছাত্রীরা রাজপথ ছাড়েনি, ক্যাম্পাস ছাড়েনি। মিটিং মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়ে গিয়েছে। স্বৈর–শাসনের আমলে উত্তাল সময়েও ছাত্রীদের ড্রেস নিয়ে কথা আসেনি। সেসময়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল শতকরা বিশ জনেরও কম। তাদের নিরাপত্তার জন্য এ্যাপরন জাতীয় কোন পোশাকের প্রয়োজন হয়নি।
নব্বই দশকের পরে দু’হাজারের প্রথম দশকে কলেজ ছাত্রীদের অনেকের মাঝে হিজাব পরার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মাঝেও লক্ষ্য করা যায়। হিজাব পরা, না পরা নিয়ে ছাত্রীদের মাঝে কোন ধরনের মত দ্বৈততা তেমন লক্ষ্য করা যায় না। যারা পরে, যারা পরে না, সবাই একসাথে চলাফেরা করে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। যে যার মতো করে চলাফেরা করে। পছন্দের বড় ওড়না মাথায় দিয়ে বা হিজাব পরে মেয়েরা অনায়াসে ঘুরাঘুরি করে। ক্লাস করে, সেমিনারে অংশ নেয়। কেউ এসব নিয়ে কথা বলে না।
দ্বিতীয় দশকে মেয়েদের মাঝে আরেক ধরনের পোশাক লক্ষ্য করা যায়। এত বছরের এ্যাপরন তারা আর পরতে চায় না। আধুনিক ডিজাইনের বোরকা পরে তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে। যা এক সময়ে কল্পনাও করা যেতো না। দিনে দিনে বোরকা পরা ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনো এ ধরনের পোশাকের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেনি। কোথাও কোথাও ভেতরে ভেতরে সমর্থন দিয়েছে। আবার কিছু সংখ্যক মেয়ে এমন সব পোশাক আশাক পড়ে আসতো যা অনেকটা দৃষ্টিকটু দেখাতো। তাদেরকেও কর্তৃপক্ষ তেমন একটা নিষেধ করতে পারেনি। তাদের সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা হলেও অন্যরা অনুসরণ করতে পারে। ছাত্র বা ছাত্রী সবার স্বাভাবিক মার্জিত পোশাক পরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা উচিত। মেয়েদের নিরাপত্তা, আব্রু, ধর্মীয় মনোভাব, পর্দা প্রথা কিংবা হাল ফ্যাশন যাই বলি না কেন হিজাব আর বোরকা পরা ছাত্রী সংখ্যা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েই চলেছে। শতকরা আশি ভাগ মেয়ে হিজাব বা বোরকা পরে ক্লাসে আসে। এদের কেউ কেউ আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত। কেউ রাজনীতিও করে থাকে। তবে এদের সংখ্যা একেবারে সীমিত। আসলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই বললে চলে। রাজনীতিও নেই। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি আর রাজনীতির নামে অপরাজনীতি চলে। হাতে গোনা কয়েকজন এসবের সাথে জড়িত থাকলেও প্রায় ছাত্র–ছাত্রী এসব থেকে দূরে থাকে।
বর্তমানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি অগ্রগামী। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ভালো। মেধা তালিকায়ও মেয়েদের সাফল্য তুলনামূলকভাবে এগিয়ে রয়েছে। এর মূল কারণ মেয়েরা লেখাপড়ায় যেভাবে সময় দেয় ছেলেরা সেভাবে দিতে পারে না। বাইরে ঘুরাঘুরিতে অনেক সময় চলে যায়। তবে ক্যাম্পাসে কোন অনুষ্ঠান হলে মেয়েরাও আনন্দে মেতে উঠে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড না থাকলে ছাত্র–ছাত্রীদের মানসিক বিকাশ হয় না। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে শিক্ষার্থীরা সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। মোবাইলে তারা সময় কাটায়। তাদের সুষ্ঠু বিনোদন প্রয়োজন। খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। বর্তমানে এ দু’টির কোনটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। সুস্থ ধারার কোন রাজনীতিও নেই। নৈতিকতারও অবক্ষয় ঘটেছে সর্বত্র। ফলে শিক্ষার্থীদের যে মননশীলতা তৈরি হওয়ার কথা তা আর গড়ে উঠছে না। দেশপ্রেমিক নাগরিক হয়ে উঠার যে সুযোগ তাও ব্যাহত হচ্ছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ অপরিহার্য। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্ত চিন্তার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ছাত্র সংসদকে কার্যকর করার গুরুত্ব রয়েছে। একইসাথে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা ও খেলাধূলায় ছাত্র–ছাত্রীদের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী