শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ : প্রেক্ষিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়

বিলাস কান্তি দাস | রবিবার , ৩০ জুন, ২০২৪ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)’র ২০২৩ সালের খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এর মধ্যে দেশে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী কমেছে ১০ লাখের উপরে। তারা বলছে, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৯২ লাখের বেশি। ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজার। তবে যে সব কলেজে মাধ্যমিক শ্রেণি আছে, সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো বেড়েছে। কী কারণে এত শিক্ষার্থী কমল, তা নিয়ে ব্যানবেইস গবেষণা করেনি। তবে তারা দেখিয়েছে, এই চার বছরে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে আড়াই লাখের মতো। তাহলে বাকি বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় গেল? ধারণা করা যায়, তারা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস হওয়ার পর ধীরে ধীরে প্রায় শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। তবে এসব শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক স্তর পার হতে পারছে না। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এস এস সি বা সমমানের পরীক্ষা দেয়ার আগেই তাদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভালো কোনও চাকরি পায় না। তা ছাড়া এসব শিক্ষার্থী অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অর্জিত শিক্ষা ভুলে যায়। তারা পরিণত হচ্ছে অদক্ষ জনবলে।

বাংলাদেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দরিদ্র্যতা। এ যুগে প্রত্যেক অভিভাবকই চান, তাঁর সন্তান পড়ালেখা শিখুক। তবে দরিদ্র অভিভাবককে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, উপরের শ্রেণিগুলোয় শিক্ষার ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রাইভেটকোচিং, নোটগাইড, ভর্তি ফিবেতন, শিক্ষার উপকরণ, পোশাকপরিচ্ছেদ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর খরচ হয়। খরচের এই চাপ সামলাতে পারে না এসব দরিদ্র পরিবার। পরীক্ষায় ফেল করার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাসফেলের ব্যবস্থা আছে, তবে কীভাবে শিখনঘাটতি পূরণ করে আগানো যায় তার কোনও পরিকল্পনা নেই। আবার কোনও ধরণের সনদ বা শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও প্রমাণ ছাড়াই শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে যাওয়ার সুযোগ থাকায় অনেক দরিদ্র পরিবার ধারদেনা বা ভিটেবাড়ি বন্ধক অথবা বিক্রি করে হলেও পড়ালেখা বন্ধ করে অল্প বয়সের ছেলেদের আয়রোজগারের জন্য বাধ্য হয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এক্ষেত্রে শ্রমিক ভিসায় বহির্বিশ্বে যাতায়াতের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার ন্যূনতম কোনও সনদ (মাধ্যমিক পর্যন্ত হতে পারে) বাধ্যতামূলক করা যায় কিনা ভেবে দেখা দরকার। তাহলে অন্তত কিছু পরিবার সে পর্যন্ত ছেলে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাবে। কিশোর গ্যাং কালচার চালু হওয়ার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া দরিদ্র বা সচ্ছল পরিবারেরও অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা বন্ধ করে ঐ পথে অগ্রসর হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া অশুভ এই কিশোর গ্যাং এর দৌড়াত্ম প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে আরও কিছু বাড়তি কারণ থাকে। যেমন বিদ্যালয়ে যাওয়া আসার পথে অনেক সময় বখাটেদের হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। আবার এ বয়সেই বাল্য বিবাহের স্বীকার হতে হয় মেয়েশিক্ষার্থীদের। অনেক দরিদ্র অভিভাবক মনে করেন, মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে। শহরের চেয়ে গ্রামীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাল্য বিবাহের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার ছেলে শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। ছেলেসন্তানের ক্ষেত্রে মনে করা হয়, সে পড়াশোনা শেষ করে ভবিষ্যতে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর পড়াশোনা কষ্ট করে চালানো হলেও মেয়ে শিশুর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতিবছর উপবৃত্তিসহ অন্যান্য খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছে। এরপরও এত বেশি শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ছে, এ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।

শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরে ব্যয় করার জন্য বিশ্বব্যাংক গত বছরের শেষে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। কোভিডজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে, শিখনফলের মানোন্নয়ন ঘটাতে এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনতে এ অর্থ ব্যয় করার সুপারিশ করেছে তারা। এবছর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে ইউনিসেফ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এসব পদেক্ষেপ ও উদ্যোগ সমন্বিত করে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্যালয় ও অভিভাবকের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি পরিদর্শন( হোম ভিজিট) করে তাদের প্রকৃত সমস্যা বের করে আনতে হবে।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির কিছু প্রস্তাবনা যেমনবিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশের মানোন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য আবাসন এর ব্যবস্থা করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে বিদ্যালয়ের সময়সূচীর পরিবর্তন আনা, মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের যাতায়াতের পথ নিরাপদ করা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি। এসব যুগোপযোগী প্রস্তাবনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আদৌ কখন হবে তা সময় বলে দেবে। শিক্ষার্থীরা যে কারণেই ঝরে পড়ুক না কেন, তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উপবৃত্তির টাকার পরিমান ও আওতা বাড়াতে হবে। অর্থ প্রাপ্তির পদ্ধতি সহজ করতে হবে যাতে দরিদ্র অভিভাবকরা অযথা হয়রানির স্বীকার না হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে যাতে আরো মনোযোগী ও আন্তরিক হন, তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের উপযোগী স্মার্ট নাগরিক তৈরী করতে হলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার দ্রুত হ্রাস করার কোনও বিকল্প নেই।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবুবলীর নিউজ শেয়ার করে হাসলেন অপু