শিক্ষা, জ্ঞান–বিজ্ঞান এবং প্রশাসনের জগত প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রযাত্রায় কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার ও প্রভাব বিস্ময়কর। উপগ্রহের সাহায্যে জ্ঞান–বিজ্ঞান ও তথ্যাদি প্রচার এবং বিস্তারের সুযোগ এসেছে; দূরতম বিশ্বকে নিকটতম করার ব্যবস্থা হয়েছে; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন এবং কর্মসংস্থানে হয়েছে অভাবনীয় গতিশীলতার সঞ্চার। সর্বক্ষেত্রে আধুনিক জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সংগতি রেখে জ্ঞানের শাশ্বত আলোকে আমাদের শিশুকে আলোকিত ও সত্যিকার জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করার মহান লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে আমাদের প্রিয় জন্মভূমিতে বাংলাদেশে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক আওতায় প্রচেষ্টা ছাড়াও সারা বিশ্বের মানুষ স্কুল কলেজের মত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তাদের সন্তানদের দেহ, মন ও আত্মার সুষম ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নে সদা সচেষ্ট।
স্কুল এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা একটি সাধারণ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকরা মনে করি, শিক্ষার্থীরা সবসময় থাকবে ভদ্র, নম্র, মনোযোগী এবং সর্বদাই চমৎকার আচরণ প্রদর্শন করবে। শিশুরা কিংবা কম বয়সি শিক্ষার্থীরা তাদের বয়স অনুযায়ী স্বভাবগত কিছু ভিন্নধর্মী আচরণ করবেই। তাছাড়া বিভিন্নজন বিভিন্ন পরিবার, পরিবেশ ও অবস্থা থেকে এসেছে। তাদের সবার পক্ষে একই ধরনের আচরণ, সদাচরণ আশা করা ঠিক হবে না। তারা সবসময় আমাদের কাঙ্ক্ষিত আচরণ নাও করতে পারে।
কিন্তু বর্তমান পরিস্তিতিতে এ আচরণগত সমস্যা কিছুটা প্রকট হয়েছে এবং সমাজের বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে যা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে আসলে শিশু–কিশোররা কেন এ ধরনের আচরণে জড়িয়ে পড়ছে, বিভিন্ন অপরাধ করছে এবং মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে সে বিষয়ে আমাদের পূর্ণ ধারণা, চিন্তা ও গবেষণা থাকতে হবে। শিশু কিশোরদের মধ্যে বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র–ছাত্রীরা এ ধরনের আচরণ করছে এবং বিভিন্ন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে আমাদের শিক্ষক সমাজ, অভিভাবক এবং Community Leader–দের ভাবতে হবে এবং এর প্রতিকার ও এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য, মোকাবেলার জন্য আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তা নাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে– আমাদের দেশ হবে মেধাশূন্য, দেশের নেতৃত্ব হবে দিকপাল হারা যা কোনক্রমেই আমাদের কাম্য নয়।
আমরা জানি, বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হল শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি ঘটানো। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণির বাইরে অনেক শিক্ষার্থী নানা ধরনের সমস্যামূলক আচরণ করে থাকে। সাধারণ আচরণগত সমস্যাগুলো নিচে দেয়া হলো:
আচরণগত সমস্যাসমূহ
১. স্কুলের শৃঙ্খলা না মানা।
২. Chronically স্কুলে দেরি করে আসা।
৩. শিক্ষকদের কথা না শোনা।
৪. স্কুলের Discipline Code এর প্রতি শৈথিল্য।
৫.সময়ানুবর্তিতার প্রতি শৈথিল্য।
৬. কিশোর Gang বা Gang Activities
৭. মাদক বা সিগারেটের নেশা।
৮. মেয়েঘটিত ব্যাপার।
৯. Mental Health.
১০. Broken family.
১১. পারিবারিক সমস্যা। ইত্যাদি
আচরণগত সমস্যার কারণ
হয়রানি বা Harassment শিকারের কারণে।
জেনেটিক প্রভাব।
পরিবেশগত কারণ।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
শিক্ষাগত প্রভাব। (অনুপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি; মানসিক চাপ এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাব যা শিক্ষার্থীদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে)
প্রশিক্ষণের অভাব।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা।
পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব।
ঘরের বা স্কুলের কোন সমস্যা তাদেরকে উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত করলে।
ইত্যাদি
আচরণগত সমস্যার লক্ষণ (Symptoms)
অযথা রাগ, ক্রোধ, আক্রমণত্বাক আচরণ।
নিয়ম লঙ্ঘন বা কর্তৃপক্ষের অমান্য করা।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
বার বার মিথ্যা বলা, জিনিসপত্র চুরি করা।
মানসিক চাপ থেকে নিজের ক্ষতি করা (Self harm)
আচরণগত বিভিন্নধর্মী ও সমস্যা ভারসাম্যহীনতা।
ক্লাসে বিলম্বে উপস্থিত হয়।
শ্রেণিকক্ষের কোনো কাজে মনোযোগী হয় না।
কোনো কাজে অংশগ্রহণ করে না, অংশগ্রহণ করলেও ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকে কিংবা ফাঁকি দেয়।
উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে।
বাড়ির কাজ নিয়ে আসে না।
আচরণগত সমস্যা সমাধানের বা প্রতিকারে অভিভাবক ও শিক্ষকের করণীয় :
১। জেনেটিকভাবে কিছু বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী যা বংশনুক্রমে পেয়ে থাকে। সেগুলোকে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যালেন্স করা এবং দক্ষতায় রূপান্তর করা।
২। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনে Encourage করা।
৩। শিক্ষার্থীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন।
৪। শিক্ষার্থীর সম্পর্কে দৃষ্টি রাখা, তার চাহিদা পূরণে সহায়তা, আগ্রহ, জোঁক প্রবণতাকে মূল্যায়ন করা।
৫। সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর ব্যবস্থা।
৬। শিশুমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
৭। জীবনশৈলী (Lifestyle) শিক্ষা ব্যবস্থা।
৮। শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টিতে আগ্রহী করে তোলা।
৯। শিক্ষার্থীর গুরুত্ব প্রদান, তার গঠনমূলক কথা গ্রহণ করা।
১০। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করা।
১১। নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া।
১২। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা প্রদান, পঠন–পাঠনে নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করাকে উৎসাহিত করা।
১৩। শ্রেণিকক্ষে মানসিক সম্পর্ক (শিক্ষক–শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী–শিক্ষার্থী সম্পর্ক) সৌহার্দ্যপূর্ণ করা।
শিক্ষার্থীদের একাডেমিক উন্নয়নে শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেন এবং তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্যে করেন। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করেন, তাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠদানে উৎসাহিত করেন এবং তাদের আচরণগত উন্নয়নে সহায়তা করেন।
শিক্ষক–অভিভাবক নিচে লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবেন:
১. শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গঠন: সন্তানের মনে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা অপরিহার্য। শিক্ষাকে একটা কঠিন দায়িত্ব নয় বরং জ্ঞান অর্জনের একটি আনন্দময় প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করা। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং শিক্ষার সাথে জীবনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
২. সন্তানের শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ: প্রত্যেক শিশুরই কিছু শক্তি ও দুর্বলতা থাকে। অভিভাবকদের সন্তানের এই শক্তি ও দুর্বলতাগুলি চিহ্নিত করে তাদের শিক্ষাকে সঠিক দিকে নির্দেশনা দেওয়া উচিত। দুর্বলতাগুলি পূরণ করার জন্য উপযুক্ত সহায়তা প্রদান করা ও শক্তিগুলি বিকাশে উৎসাহ দেওয়া জরুরি।
৩. সম্পূর্ণ সমর্থন প্রদান: পড়াশোনার সাথে সাথে সন্তানের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের প্রতি ও নজর দেওয়া উচিত। খেলাধুলা, কলা, সংগীত ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপে তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন প্রদান করা উচিত। এগুলি শিশুর বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. স্কুলের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ: স্কুলের শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং সন্তানের শিক্ষাগত অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে থাকা অত্যন্ত জরুরি। কোনও সমস্যা উঠলে সময়মতো তার সমাধান করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে মিলিত হওয়া প্রয়োজন।
৫. সন্তানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি: একটি শান্ত এবং পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার সময় ব্যাঘাত সৃষ্টি না করা এবং সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করা উচিত।
এই সকল বিষয়ের উপর নজর দিলে আমরা সন্তানদের শিক্ষার মান উন্নয়নে অনেক অবদান রাখতে পারব। আপনাদের সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ
৬. নৈতিকতা ও ধার্মিকতা মূল্যবোধের বিকাশ সাধন: ধার্মিকতা জাতিকে উন্নত করে। শিক্ষার্থীদের মনে নৈতিকতার আলো প্রজ্জলিত করতে পারলে পরবর্তীকালে যখন সে বড় হবে সে আলো তাকে পথ দেখাবে, তাকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে।
শিক্ষক এবং অভিভাবক শিক্ষার্থীদের জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন ভালো শিক্ষক, একজন সচেতন অভিভাবক শিক্ষার্থীর জীবনে আনতে পারেন আমূল পরিবর্তন। তাই ছাত্র–শিক্ষক–অভিভাবক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে আমাদেরকে একই পেজ (Same Page) এ অবস্থান করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম তথা শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: অধ্যক্ষ ও একাডেমিক ডাইরেক্টর, চিটাগাং আইডিয়্যাল হাই স্কুল, চট্টগ্রাম।