শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে কিছু করণীয়

মো. দিদারুল আলম | বৃহস্পতিবার , ২০ জুলাই, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

ঈদের ছুটি উপলক্ষে পাঁচদিন পড়া বন্ধ, এখন আবার নানাবাড়ি। হাই খোদা, আমার কন্যা কি এইবার পাশ করবে আদৌ?’ চট্টগ্রাম শহরের একটি স্বনামধন্য স্কুলের একজন ৩য় শ্রেণির সম্মানিত অভিভাবকের একটি ফেসবুক এ করা পোস্ট এটি। এই পোস্টে মোট পাঁচটি কমেন্টস দেখলাম সবারই মোটামুটি একই মতামত তাদের সন্তানদের যে অবস্থা তাতে ২য় সাময়িক পরীক্ষায় পাশ করা যাবে কিনা? কয়েকদিন আগের অন্য আরেকজন অভিভাবকের করা একটি পোস্ট দেখলাম এ রকম ‘এইবার ২য় সাময়িক পরীক্ষার জন্য যেহেতু সময় কম সেহেতু পড়া, নোট দিয়ে সবাই সহযোগিতা করবেন প্লিজ।’ একই গ্রুপে একদিন দেখলাম একটি অসুস্থ বাচ্চার ছবি যাতে মাথায় জলপট্টি দেয়া এবং গায়ের উপর লেপ জড়িয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটি। নিচে পোস্টে লিখা আমার বাচ্চা খুবই অসুস্থ তাই স্কুলে যেতে পারে নি বলে আজকের স্কুলের পড়াগুলো পোস্ট করতে পারবে না।

আমার এক বন্ধুর স্ত্রী তাঁর ২য় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে পড়াতে বসিয়ে প্রায় বেত দিয়ে পেটান। আমার বন্ধু আমাকে বিষয়টি বলে জানতে চাইলেন সে এক্ষেত্রে কী করতে পারে? আমি বললাম, সরকার ক্লাশরুমে বেত নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু বাসায় বেতের ব্যবহার বন্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো পরিপত্র জারি করেছে বলে আমার জানা নেই। সবচেয়ে মজার বিষয় তার স্ত্রী অনেক বছর পূর্বে আমার ছাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রী ছাত্রজীবনে তেমন কোনো কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন বলে আমার মনে পড়ে না অধিকন্তু তার নিকট হতে একটি ইংরেজি প্যারাগ্রাফ আদায় করতে অনেক দিন সময় লেগেছিল। এখন সে তার নিজের জীবনের ব্যর্থতা তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে দ্রুত ঢেকে দেওয়ার মিশনে নেমেছেন হয়তো।

শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাকগণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া উচিত’ শিরোনামে বিগত ৩ জুলাই দৈনিক আজাদী পত্রিকায় আমার একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যক্তিগণ ওয়াটস্‌অ্যাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন এবং সাথে কিছু পরামর্শও প্রদান করেন। মোটামুটিভাবে বেশিরভাগ ব্যক্তি আমার লেখার বক্তব্য ও উদাহরণসমূহের বিষয়ে একমত পোষণ করেন এবং নিজেদের কিছু অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন। তাদের মন্তব্য এবং পরামর্শের উল্লেখযোগ্য কিছু আমি পাঠকগণের সামনে আলোচনায় নিয়ে আসছি। তাদের পরামর্শগুলো হতে অভিভাবকগণের করণীয় সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। একজন শিক্ষা অফিসার মন্তব্য করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ঠেকে শিখে আর নামকরা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্কুল ও অভিভাবকগণ এক গাদা বোঝা চাপিয়ে দেন। বিষয়টিকে তিনি তুলনা করেছেন মুরগির ডিমে তা দেওয়ার সাথে। মুরগির ডিমে তা দেওয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাচ্চা ফুটে। যদি বাহির হতে অতিরিক্ত চাপ দিয়ে বাচ্চা ফুটাতে যাই তবে ডিম ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্য একজন শিক্ষা অফিসার ফোন করে বলেছেন আপনার বক্তব্য সবাই বুঝেন কিন্তু নিজেদের সন্তানদের বেলায় তা প্রয়োগ করেন না।

একজন সরকারি কর্মকর্তা লিখেছেন, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানোর সাথে সাথে অভিভাবকগণেরও ক্লাশ শুরু হয়ে যায়। সকালটা শুরু হয় বাচ্চাকে বিছানা হতে তুলে জোরপূর্বক মুখে ব্রাশ করানোর মধ্য দিয়ে। আমাদের বাচ্চাগুলোকে দেখলে খুব মায়া হয়। একটি ঘটনা বর্ণনা করি আমার মামার বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া গ্রামে। সেখানে বিজিবির একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। প্রতিদিন সকালে বিজিবির জোয়ানদের বিশেষ করে নব জোয়ানদের বহুদূর পর্যন্ত পিঠে ইট দিয়ে দৌঁড়াতে হয়। এই দৃশ্য খুবই মর্মান্তিক ছিল। আমরা অপলক দৃষ্টিতে দেখতাম। অনেক জোয়ান হাঁটতে পারতো না। অনেকে লুকিয়ে থাকতো। ধরা পড়লে শাস্তি হত তাদের। আমাদের শহরে সকাল বেলা ঠিক একই চিত্র দেখা যায়। বাচ্চাদের কাঁধে এক গাদা বই দেখলে আমার ঐ জোয়ানদের কথা মনে পড়ে। এগুলি বই নয়, যেন ইট পাথর।

একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক লিখেছেন আমার মেয়েকে বাইরে ১০ মাস পড়িয়েছি, সেখানে কোনো অভিভাবককে দেখিনি ক্লাশ শেষে বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করতে কী পড়িয়েছে। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাটাই আসলে এরকম, কোনো কিছুতেই বাচ্চাকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দেয় না। অন্য আর একজন সহযোগী অধ্যাপক হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার নিজের বাচ্চাকে নম্বরের পিছনে না ছুটিয়ে শুধু তাদের ক্লাশ উপযোগী মৌলিক বিষয়ের ধারণাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। পাবলিক ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের এক শিক্ষক লিখেছেন মানুষ বুঝে না যে তার সন্তানের জীবনের অনেক পরীক্ষা বাকি, প্রাথমিক স্তরে প্রথম হয়ে পরে যদি পিছিয়ে যায় তাহলে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার কোনো মানে হয় না। একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক লিখলেন, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে কাজের কাজ কিছুই হয় না। সত্যিকারের ট্যালেন্ট যারা তারা আলো ছড়াবেই। ইউসেপ স্কুলের এক শিক্ষক লিখেছেন, তার স্ত্রী (একটি বেসরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক) চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ হতে এইচ এস সি পরীক্ষায় গণিতে ৯৯, পদার্থ বিজ্ঞানে ৯৮, রসায়নে ৯৮ নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু তার মেয়েরা তাদের মায়ের মতো নম্বর পাচ্ছে না, এ নিয়ে সংসারে যত অশান্তি। একজন সরকারি চাকরিজীবী মা লিখেছেন বাচ্চাদের চাপ দিতে আমার মোটেও ভাল লাগে না অথচ স্কুলে গেলে বুঝা যায় কিছু কিছু বাবামা বাচ্চাদের রোল ১, ২ হওয়া নিয়ে কতো টেনশনে থাকেন পাশাপাশি বাচ্চাগুলোকে মানসিক চাপে রাখেন। তখন নিজেদের খুব অসহায় লাগে, আর মনে মনে ভাবি আমি কেন তাদের মতো করছি না বা আমি কি আমার বাচ্চাদের অবহেলা করছি। অন্য এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মা ফোনে বললেন অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধতো করব কিন্তু কোন Scholarship এর জন্য আবেদন করলে পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। একজন বাংলা চলচ্চিত্রের চিত্র গ্রাহক ও আইটি প্রশিক্ষক লিখেছেন তিনি তার নিজের বড় বোনকে দেখেছেন চাপমুক্ত রেখে তিন সন্তানকে পড়াতে যারা বর্তমানে খুব ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।

একজন মাধ্যমিকের প্রধান শিক্ষক লিখেছেন সম্মানিত অভিভাবকগণ ভালো মানুষ গড়ার চেয়ে বেশি টাকায় সাইন বোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে সন্তান ভর্তি করিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার রেওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘This has created a cancerous effect on the so-called modern parents. They do not know that they are spoiling the natural childhood of their children.অন্য একজন একটি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষানুরাগী সদস্য লিখেছেন, আমি অভিভাবক প্রতিনিধির মিটিং এ অভিভাবকগণের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়টি উপস্থাপন করব। একজন পৌরসভার সিও লিখেছেন, মাঝেমাঝে মনে হয় অভিভাবকগণকে নিয়ে প্রতিটি স্কুলে বিভিন্ন সময়ে কাউন্সেলিং করানো উচিৎ যাতে তারা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন না থাকেন। অসুস্থ প্রতিযোগিতার নেতিবাচক প্রভাব অভিভাবক ও সন্তান উভয়ের উপরেই পড়ে। একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছেন, মানবিক মানুষ হওয়া জরুরিএ কথা অভিভাবকগণ ভুলতে বসেছেন বলে মনে হয়। একজন উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা লিখেছেন বাচ্চাদের পড়াশুনা নিয়ে আমরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। বিশেষ করে মায়েরা। হয়তো বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই করছি কিন্তু এটি করতে গিয়ে আমরা বাচ্চাদের স্বর্ণালী শৈশব ধূসর গোধূলি বানিয়ে ফেলেছি। একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মা লিখেছেন আমি আমার সন্তানদের দুরন্ত শৈশবকে পুরোপুরি উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছি।

লেখক: নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাগতম ১৪৪৫ : হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব তাৎপর্য ও ক্রমবিকাশ
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম