বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে শিক্ষার্থীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিগত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য থাকলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান দেশের এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জনে। বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে বারবার পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীতিনির্ধারকদের অসংগঠিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে শিক্ষাব্যবস্থা একটি স্থিতিশীল কাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের দেশে শিক্ষায় অসতর্কতার ফলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। নীতিনির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্ত, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না করা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা ইত্যাদি কারণে শিক্ষার গুণগত মান ব্যাহত হচ্ছে।এছাড়াও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব অন্যতম আরেকটি কারণ। এই বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক যে বাংলাদেশের শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির মাত্র ২.০৮%, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী, এই বরাদ্দ ৪–৬% হওয়া উচিত। অর্থের অভাবে গ্রামীণ অঞ্চলের স্কুলগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও বেসরকারি শিক্ষার উচ্চ ব্যয় ও বৈষম্য সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষার মধ্যে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে রেখেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে, ফলে সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। গ্রামাঞ্চলের অনেক স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী নয়, এবং শ্রেণিকক্ষের পরিবেশও মানসম্পন্ন নয়। বাস্তবমুখী শিক্ষার অভাব একটি অন্যতম কারণ শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো তত্ত্বীয় শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল।সৃজনশীলতা ও মৌলিক চিন্তার অভাব রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীরা গবেষণাধর্মী বা সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় পিছিয়ে থাকছে। এর ফলে তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এমনকি কর্মসংস্থান–বান্ধব শিক্ষা নিশ্চিত না করায় শিক্ষার্থীরা চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন,‘শিক্ষার্থীদের জন্য এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন যা তাদের বাস্তবজীবনের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করবে।’ এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলবে। আমাদের শিক্ষানীতিতে মৌলিক দক্ষতা ও বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’ প্রযুক্তি–নির্ভর শিক্ষা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে তা এখনো সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নন। বর্তমান চাকরির বাজারে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট নয়, বাস্তব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন যে, ডিগ্রি অর্জনের পরেও শিক্ষার্থীরা বাস্তব কাজের উপযোগী নয়।’
শিক্ষা মুখস্থ নির্ভর হওয়াতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শিক্ষাকে বৈষম্যমূলক করে তুলেছে, কারণ আর্থিকভাবে দুর্বল #শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং সমাজে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি শুরু করেছে। এমনকি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করলে দেখা যায় তাদের অন্যান্য দুর্বলতার পাশাপাশি পঠন–পাঠনের ভাষাগত সমস্যাও প্রকট।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কোচিং নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং শিক্ষকদের ক্লাসে মনোযোগ কমাতে উৎসাহিত করছে।’ এছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে ভয়ংকরভাবে।
একাডেমিক চাপ, প্রতিযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং অভিভাবকদের অতিরিক্ত প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মনোবিজ্ঞানী ড. হাসিনা খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ সামলানোর জন্য স্কুল পর্যায়ে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়টি প্রায় অনুপস্থিত।’
এছাড়াও বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ একটি বড় সমস্যা। ছাত্র রাজনীতি অনেক সময় শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা ছাড়া শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি সম্ভব নয়।’
মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অভাব দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ কমছে, যা ভবিষ্যতে সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
আবার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের বিভাজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসমতা তৈরি করছে। শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামানের মতে, ‘দ্বিভাষিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজস্ব ভাষার প্রতি আগ্রহী থাকার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।’
আমাদের দেশে আরো একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম প্রণেতা ড. কাজী কামালউদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।’ মানসম্মত শিক্ষকের অভাব বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক রয়েছেন, তবে তাদের বেশিরভাগই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। এর পাশাপাশি প্রযুক্তির অপব্যবহার ও আসক্তি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় হুমকি স্বরূপ। শিক্ষার্থীরা শিক্ষার চেয়ে বিনোদনের জন্য প্রযুক্তির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অসতর্কতার কারণে শিক্ষার্থীদের জন্য নানা দুর্ভাবনা অপেক্ষা করছে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন, বাস্তবমুখী শিক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে আনা–এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। সরকার, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টেকসই, মানসম্মত ও বাস্তবমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই একমাত্র সমাধান। নীতিনির্ধারকদের উচিত এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক : প্রভাষক, ইংরেজি, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম