অতি সম্প্রতি ‘টুয়েলভথ ফেল‘ নামক একটি ভারতীয় সিনেমা দেখি। পরিচালক ছিলেন ‘থ্রি ইডিয়টস্‘ খ্যাত বিধু বিনোদ চোপড়া। উনার প্রত্যেকটা সিনেমাতেই সমাজের কোন একটা অসংগতি তুলে ধরে, এবং সেটির প্রতিকারের জন্য একটা সামাজিক মেসেজ দেন। ‘টুয়েলভথ ফেল‘ সিনেমাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সিনেমায় দেখানো হয়ে একটি গ্রামে পরীক্ষার সময় সবাই নকল করে, এবং এতে সার্বিক সহযোগিতা করে ওই এলাকারই জনপ্রতিনিধি বা চেয়ারম্যান। অনেকটা নকলের মহোৎসব বলা যায়। প্রশাসনের লোকদেরকে টাকা দিয়ে কেন্দ্র পরিদর্শনে না আসার জন্য উৎসাহিত করে বা উনারা আসেন না। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, নকল করিয়ে জনগণকে পাস করানোর মাধ্যমে তাদের বেকুব বানিয়ে রাখা যায়। আর মানুষ অশিক্ষিত বেকুব হলে তাতে জনপ্রতিনিধি সাহেবের মোড়লগিরি করতে সুবিধা হয়।
একসময় আমাদের দেশেও এরকম নকলের মহোৎসব হতো। এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে ছেলে–মেয়েদের নকল সাপ্লাই দিতে যেত অভিভাবক বা বড় ভাই বোনেরা। ক্ষেত্রবিশেষে পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত শিক্ষকরাও নকলে সহযোগিতার সাথে যুক্ত ছিলেন। পরীক্ষা নেওয়ার সার্বিক দায়িত্বে থাকা এলাকা প্রধান, শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষার্থী সবাই শুধু খবর রাখতেন কখন ম্যাজিস্ট্রেট আসবে। ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন এটা শুনলেই, পুরো পরীক্ষা কেন্দ্রে পিনপতন নীরবতা। মনে হতো এর চেয়ে ভালো পরীক্ষা কেন্দ্র বাংলাদেশে আর একটিও নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেট আসার খবর শুনে সবাই দৌড়াত যে যার মতো। দৌড়াতে গিয়ে তখন কেউ কেউ হাত–পা ভেঙ্গে ফেলছে এমন কথাও আমরা শুনেছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট কেন্দ্র হতে চলে যাওয়ার পর আবার নকল চলতে থাকে পুরোদমে।
একটা পর্যায়ে আমরা দেখলাম, ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে শিক্ষামন্ত্রী দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিদর্শনে যাওয়া শুরু করলেন। এতে কেন্দ্র প্রধান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী সবার মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ শুরু হয়। তারপরও নকল বন্ধ করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। দেশের নীতি নির্ধারকরা চিন্তায় পড়লেন কিভাবে নকল বন্ধ করা যায়। কিন্তু এটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে পরীক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের মাধ্যমে। আমরা দেখতে পায়, সৃজনশীল পদ্ধতিটি পরীক্ষা কেন্দ্রে নকল বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিশাল একটি ভূমিকা রাখে। আগে গৎবাঁধা কতগুলো প্রশ্নই কয়েক বছর পর পর পরীক্ষায় পুনরায় আসতো। তখন কিছু কিছু শিক্ষককে যাদুকর মনে হতো। উনারা বলতেন এই অধ্যায়ের এই অংকটা আসবে, পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা যেত ওই অংকটাই আসছে হুবহু। এসময় সাজেসন্স ব্যবসাটাও ভালো চলেছে। সাজেসন্স থেকে মোটামুটি সব চলে আসতো। শিক্ষার্থীরা যেটাকে ‘কমন পড়া‘ বলে। তাতে নকল করতে সুবিধা হত। সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে যখন কমন পড়া বন্ধ হল, নকল করাও অনেকাংশে কমে আসলো। নকল করা বন্ধ হয়ে আসলে পরীক্ষা কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকাও গৌণ হয়ে আসলো ।
এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় নকল করে পাস করা ছাত্ররা যত ভালো রেজাল্টই করুক না কেন সারাজীবন নৈতিকভাবে দুর্বল থাকে। কিন্তু ‘টুয়েলভথ ফেল‘ সিনেমায় আমরা যা দেখলাম তা হলো এর পুরো উল্টো। নকল করে পাস করাটাকেই একটা নিয়মে পরিণত করে ফেলেছিল ছাত্র–শিক্ষক অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোক সবাই মিলে। সেই জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও ছিল না। কিন্তু নতুন আসা একজন অফিসার নিয়ম ভেঙ্গে একবছর নকল করতে না দিলে সিনেমার নায়কসহ স্কুলের সব ছাত্র দলবেঁধে ফেল করে। ঐ অফিসারের চরিত্র ও ভূমিকা, নায়ককে ভাবায় এবং পরবর্তীতে নায়ক নকল করা ছাড়া তৃতীয় বিভাগে পাস করেও এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। পরিশেষে ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ়তা দ্বারা জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অতি সম্প্রতি আমরা সংবাদ মাধ্যমে অবগত হলাম আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এখন থেকে আর পরীক্ষার কেন্দ্র পরিদর্শনে যাবেন না। আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। রাষ্ট্রের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন মানুষ এ ধরনের পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের উপরই মানসিকচাপ থাকে না, সাথে সাথে ঐ এলাকার প্রশাসনিক ও পরীক্ষাকাঠামোর উপরও একধরনের চাপ থাকে। আমার মনে হয় যেসব কারণে ম্যাজিস্ট্রেট বা শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একসময় পরীক্ষার হল পরিদর্শনে যেতেন, সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। সৃজনশীল শিক্ষা কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে নকল করা বর্তমানে প্রায় শূন্যের পর্যায়ে। মাঝখানে প্রশ্নফাঁসের মতো একধরনের মারাত্মক ব্যাধিতে আটকে গিয়েছিল দেশ। ইদানিং তা কমে আসছে বলে মনে হচ্ছে। তারপরও সতর্কতার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবার। অননুমোদিত ফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। ট্রেজারি–থানা থেকে প্রশ্নপত্র গ্রহণ ও পরিবহন কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, শিক্ষক, কর্মচারীরা কোনো ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না এবং প্রশ্নপত্র বহন কাজে কালো কাঁচের মাইক্রোবাস বা এ ধরনের কোন যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না। একজন অনুমোদিত অফিসার ট্রেজারি, থানা হেফাজত থেকে কেন্দ্র সচিবসহ প্রশ্ন বের করে পুলিশ পাহারায় সব সেটের প্রশ্ন কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার ২৫ মিনিট আগে প্রশ্নের সেট কোড ঘোষণা করা হবে। সে অনুযায়ী কেন্দ্র সচিব,অনুমোদিত অফিসার ও পুলিশ কর্মকর্তার স্বাক্ষরে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট বিধি অনুযায়ী খুলবেন। এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে প্রশ্নফাঁসটাও রোধ হয়ে আসবে আশা করা যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন যুগোপযোগী পদক্ষেপের কারণে নকল, প্রশ্নফাঁস ও অনিয়ম বন্ধ হলে, শুধু শুধু ভীড় বাড়িয়ে সৌজন্যতার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে না যাওয়াই ভালো। ইদানিং আমরা দেখি অতিউৎসাহী অনেক সংসদ সদস্যও একদল নেতাসহ নিজ এলাকার পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে অযথা ভিড় বাড়ানোসহ শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করেন। প্রটোকলের কারণে প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত অফিসাররা সংসদ সদস্যের সাথে থাকতে হয় বিধায় নিয়মিত কাজে ব্যাঘাত ঘটে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এ ব্যাপারেও নজর দেওয়া, এবং এ সংস্কৃতি বন্ধ করা দরকার।
আমরা চাই শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসুক। শিক্ষার্থীরা ‘টুয়েলভথ ফেল‘ নায়কের মত বুঝতে শিখুক নিজের জীবনে ভালো পরিবর্তন চাইলে নিজেকেই সেটা করতে হবে। কেউ একজন উৎসাহ বা আত্মবিশ্বাস যোগাবে। ভয় দেখিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভালো পরিবর্তন করা গেছে তার উদাহরণ পৃথিবীতে কম। তাই মন্ত্রী মহোদয়ের কেন্দ্রে না যাওয়াটাকে আমি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ দূর করার পাশাপাশি জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা হিসাবে দেখছি। এ ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপকে আমি সাধুবাদ জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।