শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর টয়লেটের প্রতি কেন এত অবহেলা

মো. দিদারুল আলম | সোমবার , ১৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টয়লেটগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ ও নোংরা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত টয়লেট নেই এবং যেগুলো আছে সেগুলোও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না, যা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে। টয়লেটের রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থাও খুবই খারাপ। প্রায় অর্ধেক টয়লেট বন্ধই থাকে। আবার বেশিরভাগ বাথরুম নোংরা ও ব্যবহারের অনুপযোগী। প্রয়োজনের তুলনায় টয়লেট সংখ্যা কম থাকে, বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য আলাদা ও পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকার অভিযোগ রয়েছে। টয়লেটগুলোতে নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব দেখা যায়, যা ব্যবহারের অনুপযোগী করে তোলে। অনেক সময় টয়লেটগুলো মেরামত করা হয় না বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না, ফলে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও একটি বড় কারণ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত টয়লেট স্থাপন করা এবং নিয়মিত সেগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা, যাতে তারা টয়লেট ব্যবহারের পর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দেয়। সরকারের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর টয়লেটগুলোর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা এবং নিয়মিত তদারকি করা। ২০১৪ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের পলিসি সাপোর্ট ইউনিটের উদ্যোগে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় আইসিডিডিআরবি (আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র) বাংলাদেশ জাতীয় ভিত্তিমূল জরিপ (ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে) পরিচালনা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি চর্চার বিষয়ে ধারণা পেতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরিপ করা হয়।

জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ স্কুলে উন্নত এবং ১২ শতাংশ স্কুলে অনুন্নত ল্যাট্রিন আছে। ৪ শতাংশ স্কুলে কোনো ল্যাট্রিন নেই। গড়ে ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি ল্যাট্রিন আছে। এটি প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। স্কুলগুলোর ৫৫ শতাংশ ল্যাট্রিনে তালা দেওয়া থাকে। খোলা থাকা ল্যাট্রিনগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যবহারের উপযোগী। ৮০ শতাংশ স্কুলে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ল্যাট্রিনের কাছাকাছি হাত ধোয়ার পানির ব্যবস্থা আছে মাত্র ৪৫ শতাংশ স্কুলে। পানি, সাবানসহ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে একতৃতীয়াংশ স্কুলে। ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য প্রতি মাসে স্কুলগুলো গড়ে খরচ করে ৬১ টাকা। ‘মাসিক’ বা ‘পিরিয়ড’ কিশোরীদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কেবল ৬ শতাংশ ছাত্রী মাসিক সম্পর্কে স্কুল থেকে জানতে পারে। কেবল ১১ শতাংশ স্কুলে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট আছে। কিন্তু মাসিক ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা আছে মাত্র ৩ শতাংশ স্কুলে। তাই ৮৬ শতাংশ ছাত্রী মাসিকের সময় স্কুলে আসতে চায় না। ৪০ শতাংশ ছাত্রী মাসিকের সময় গড়ে তিন দিন পর্যন্ত স্কুলে অনুপস্থিত থাকে।

টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার না করলে বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু যেমনব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং পরজীবী দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এই জীবাণুগুলো বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি। বিশেষত, ভেজা এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এই জীবাণুগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তাই টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার রাখা খুবই জরুরি। নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে এই জীবাণুগুলো সহজেই মানুষের সংস্পর্শে এসে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যারা টয়লেট ব্যবহার করে, তারাও যদি কাজ শেষে ঠিকমতো পরিষ্কার করে রাখতো, তাহলে টয়লেটের এমন বাজে অবস্থা হতো না। তবে প্রতিটি টয়লেটে টিস্যু ও সাবানের খুব দরকার। কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় ন্যূনতম এই সুবিধাটুকু নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টয়লেটগুলো পরিষ্কার রাখতে শিক্ষকশিক্ষার্থীদেরর ভূমিকা রাখতে হবে।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থী টয়লেট পরিষ্কার না থাকার কারণে পায়খানা ও প্রস্রাব আটকে রাখে। দীর্ঘ সময় প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে মূলত তারা ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়। ফলে জ্বর, পেটব্যথা ইত্যাদি সমস্যা তাদের লেগেই থাকে। অনেকের শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দেয়। প্রস্রাবে ইউরিয়া ও অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকে। ফলে বেশিক্ষণ চেপে রাখলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে পাথর তৈরি করতে পারে। শহুরে নারীপুরুষ উভয়ের মধ্যেই ইদানীং এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে। আবার পিরিয়ডকালীন প্রয়োজনে শৌচাগার ব্যবহার না করলে মূত্রথলির পাশাপাশি জরায়ুর ইনফেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সরকারিবেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের টয়লেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ এবং বিষয়টি খুবই অবহেলিত। কেউ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছে না। যার দরুণ, অল্প বয়সে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত টয়লেট নির্মাণ করা সময়ের দাবি। হাত ধোয়ার উপকরণ ও টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সরকারের দিক থেকে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহীনুর সরোয়ার : মঞ্চের আলোর এক অমল দীপ
পরবর্তী নিবন্ধকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে সত্য-মিথ্যার লড়াই