শিক্ষাগুরু মিহির কান্তি শীল

রনজিৎ চন্দ্র নাথ | বুধবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

আমি ব্যক্তিগত জীবনে যে কয়জন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁদের মধ্যে মিহির কান্তি শীল প্রকাশ মিহির স্যার ছিলেন অন্যতম। ঘুনে ধরা অবক্ষয়ে জর্জরিত এ সমাজ ব্যবস্থায় বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার ধুরুং গ্রামে ভারতভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতামনীন্দ্র কুমার শীল ও মাতাসুষমা শীল।

তিনি ১৯৬৯ সালের ৬ আগস্ট নাজিরহাট কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭০ সালের ০৯ মার্চ ‘কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে’ সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করে ‘সহকারী প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে ২০০৮ এর ৩০ ডিসেম্বরে সরকারিভাবে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করলেও ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি সময়ে সময়ে প্রধান শিক্ষকের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিষয়সহ যাবতীয় কার্য্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

ঐতিহাসিক কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা আসলেই মিহির স্যারের কথা আসবেই। এ যেন আত্মার সম্পর্ক। এই বিদ্যালয় এবং তাঁর প্রিয় ছাত্রদের কল্যাণের জন্য তিনি সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়েছেন। ওনার জ্ঞানের ভান্ডারে যা ছিলো তা ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতে কোন কার্পণ্য করেননি। তিনি জাতের ভেদাভেদের অনেক উর্ধ্বে ছিলেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সব ছাত্রকে ওনার সন্তানতুল্য হিসেবে দেখতেন। তাই তিনি সর্বকালের, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সর্বজনপ্রিয়, কালজয়ী শিক্ষকের মর্যদায় খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন তেমনি অভিভাবকদের কাছেও সমান প্রিয় ছিলেন। স্যারের প্রথম জীবনের ছাত্রের সন্তানও পরবর্তীতে স্যারের ছাত্র হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে।

কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মিহির স্যারের স্মরণসভায় এক বক্তা তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বিদ্যালয়ের কিছু তরুণ শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন স্যার থেকে, শিক্ষক হিসেবে তাঁর সাফল্যের রহস্য কী? উত্তরে স্যার মৃদু হেসে বললেন, ‘কোন রহস্য নেই, আপন কাজকে সম্মান করতে হবে, ভালোবাসতে হবে, আন্তরিক হতে হবে, ছাত্রদের প্রত্যেকের প্রকৃতি আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে, তদনুযায়ী পাঠদান করতে হবে। বিষয়টির প্রতি আন্তরিক ও একাগ্র হলে, মনোযোগী ও একটু সৃজনশীল হলে কাজটি সহজ।’ অল্প কথায় স্যার অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৯৩ সালে ঐতিহ্যবাহি ‘কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ বছর পূর্তি ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পুনর্মিলণী’ অনুষ্ঠানে প্রকাশিত ‘স্মরণিকা’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে বিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণাতীতকালের সেরা তথ্যভাণ্ডার হিসেবে বহুল প্রশংসিত হন। তিনি সম্পাদকীয় পাতায় লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ৬০ বৎসর আগে এক বেঞ্চিতে বসে যারা জ্ঞান চর্চা করেছিল, তাঁরা আজ আবার মিলেছে। বিস্মৃতির অতলান্ত থেকে সুখময় স্মৃতিগুলো উথলে ্‌উঠছেরোমন্থন করছে। সে যে কি আনন্দ তা উপভোগ্য বিষয়।’

মনে প্রাণে স্যারের প্রিয় বিষয় হলো গণিত ও বিজ্ঞান। এছাড়াও অসংখ্য কবিতা ও সাহিত্য লিখেছেন। তবে কবিতা ও সাহিত্য লিখলেও শুধুমাত্র একটি গ্রন্থ প্রকাশিত করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘অনন্ত ভাবনা’। এই গ্রন্থটি ছিল স্যারের মুক্তচিন্তা ও অন্তহীন ভাবনারই ফসল। ‘অনন্ত ভাবনা’ গ্রন্থটি তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় ছাত্রদেরকে ভালোবেসে প্রকাশিত গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন।

আকাশের মত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মিহির স্যার ফুসফুস ও কিডনীসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কলকাতায় একটি হাসপাতালে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সোমবার ভোর ৪ টা ৫৫ মিনিটে শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করেন। পৃথিবীতে এমন বিরল ঘটনা আছে কিনা আমার জানা নেই জন্মমৃত্যু একই তারিখে হয়। স্যারের আদর্শ, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, নীতিনৈতিকতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতার প্রচেষ্টায় প্রতিটি ছাত্রঅভিভাবকের অন্তরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং আমার মতো হাজারো ছাত্রকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি আমাদের গৌরব ও অহংকার ছিলেন এবং সারাজীবন থাকবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃত লেখক বাঁচেন স্বাধীনতায়, সত্যের সন্ধানে
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে