অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও চলতি বছর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে। নতুন কারিকুলামে বাৎসরিক সামষ্টিক মূল্যায়নের পরিবর্তে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হবে এর আগের কারিকুলামে। তবে পাঠ্যবই থাকবে নতুন কারিকুলামেই। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো ও সিলেবাস প্রস্তুত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন হবে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আদলে। প্রতিটি বিষয়ে ছোট প্রশ্ন, বড় প্রশ্নের সমন্বয়ে প্রশ্নকাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে। শিক্ষক ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে সেমিনার করে সিলেবাস ও প্রশ্নকাঠামোর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগির সিলেবাস ও প্রশ্নকাঠামো প্রকাশ করে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে, পুরোনো সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষাক্রমে রচিত বইগুলো আগামী বছর শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে এসব বই সংশোধনেরও কাজ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, যেসব বইয়ে বিশেষ করে ঐতিহাসিক ঘটনার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত কোনো তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, কিংবা অযাচিতভাবে কাউকে হিরো বানানোর চেষ্টা হয়েছে, পাঠ্যবই থেকে সেই অংশটুকু বাদ দেওয়া হবে। এ ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেসব বাণী পাঠ্যবইয়ে রয়েছে, সেগুলো মুছে দেওয়া হবে। তাকে ঘিরে কোনো অতিরঞ্জিত তথ্য বইয়ে ব্যবহার করা হলে সেটিও বাদ দেওয়া হবে।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, পাঠ্যবই সংশোধনের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমে প্রতিটি বিষয়ের তিন থেকে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক। সবমিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি ব্যক্তি পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ করছেন। তারা জানিয়েছে, চলতি মাসের মধ্যেই পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শেষ হবে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরেজমিনে গিয়ে এনসিটিবি ভবনের ষষ্ঠ তলায় অডিটোরিয়াম ও গ্রন্থাগারে পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজ চলছে তা দেখা যায়। সেখানে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিশেষজ্ঞরা। কথা হয় পাঠ্যবই পরিমার্জন টিমের সদস্য এক শিক্ষা গবেষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ চলছে। তবে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিছু কনটেন্টে হয়তো কিছু লেখা বাদ যেতে পারে। তবে কোনো কনটেন্ট পুরোপুরি বাদ যাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নন বলে জানান তিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাস পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার কোনো নির্দেশনা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর (শেখ মুজিবুর রহমান) ইতিহাস বা তাঁকে ঘিরে কোনো কনটেন্ট বাদ দেওয়া হবে–এমন কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি। বরং সেগুলোকে রাখার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে, ইতিহাসের ক্ষেত্রে যদি অতিরঞ্জিত কিছু লেখা হয়, কাউকে হিরো বানানোর চেষ্টা করা হয়, সেটি বাদ দেওয়া হবে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একটা নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এটি ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম–২০২২’ নামেই সমধিক পরিচিত। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নতুন এই শিক্ষাক্রমকে জাতির সামনে পরিচিত করানো হয়েছিলো একটি মৌলিক পরিবর্তন বা যুগান্তকারী পরিবর্তন হিসেবে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাক্রমটি চালু হলে দেশের ছাত্র–শিক্ষক থেকে শুরু করে সব সচেতন মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো থেকে ধার করে আনা এই শিক্ষাক্রম বাংলাদেশের মতো একটা অসচ্ছল দেশে কতোটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলেও অনেক প্রশ্ন ওঠে। অনেকে তখন একধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করেছিলেন, যেনো অনতিবিলম্বে শিক্ষাক্রমটি বাতিল করা হয়। এখন বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে এখন তাই নতুন করে অনেকে শিক্ষাক্রমটি বাতিলের দাবি করছেন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং কীভাবে আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া যায় সেটা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। উপদেষ্টার এই বক্তব্য জাতির জন্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিন্তু পরে তিনি আর একটি কথা যোগ করে বলেছেন, আমরা আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাবো। কিন্তু এমনভাবে ফিরে যাবো যাতে কোনো শিক্ষার্থীর পড়ালেখায় কোনো অস্বস্তি না হয়।
‘শিক্ষাক্রম’ হলো একটি আয়নাস্বরূপ, যার মধ্যে একটি দেশের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এজন্য একটি নিখুঁত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।